এপিএস বুক রিভিউ
রিভিউয়ারঃ
মরণোত্তম, সাদাত হোসাইন
‘মরণোত্তম’ একটি মরণজয়ের কাহিনি
‘ধর্ষকরাই ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাবানরাই যখন ধর্ষক’ তখন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। মানুষ তখন নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, অস্তিত্ববান এবং প্রতিবাদী একজন মানুষে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র বাসনা মনের গহীন কোণে বাসা বাঁধে। কিন্তু সবকিছু যখন নষ্টদের দখলে চলে যায়; উপায় থাকে না সুবিচার এবং মানবিকতা প্রতিষ্ঠার তখনই প্রয়োজন পড়ে জীবন-বিনাশের। তাই প্রতিবাদহীন এবং লড়াইয়ে পরাজিত একজন সৈনিকের চেয়ে মরণই উত্তম হিসেবে বিবেচিত হয়। উপন্যাসের প্লট এরকমই একজন মানুষের মরণ জয়ের কাহিনি নিয়েই গড়ে উঠেছে। তাই ‘মরণোত্তম’ শুধু একজন ব্যক্তিমানুষের কাহিনি থাকেনি পরিণত হয়েছে বৃহত্তর শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বরে।
সাদাত হোসাইন একজন প্রাতিস্বিক ও তরুণ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ এবং সেই সাথে দেশ, কাল ও সমাজসচেতন ঔপন্যাসিক। প্রতিটি লেখকের কাছে সমাজের প্রতি ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাঁরা সমাজের বিবেক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এবং করেনও তাই। তাই লেখক হিসেবে সাদাত হোসাইন সেই দায় এড়াতে পারেননি। তাঁর উপন্যাসের ভাষা, উপস্থাপনার ভঙ্গি ও চরিত্রের মুখে সংগ্রামী ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়ে সমাজের সেই ঋণের দায়ভার মিটানোর চেষ্টা করেছেন।
আমরা যে সময়টাকে অতিক্রম করছি সেটা আসলে কেমন সময় এবং কেমন মানুষের সমাজ? আমরা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি সে বিষয়ে লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টি আমাদের কাছে পরিষ্কার। নেতারা তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত; ক্ষমতা আর অর্থের প্রভাব খাটিয়ে তারা গোটা সমাজকে কব্জা করে রেখে সমাজের মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছে। তাই সেখানে বিবেকবান মানুষের সংখ্যা অতি অল্প। এখানে পুলিশ, সাংবাদিক, সমাজকর্মী কেউই নির্যাতিতের পক্ষে থাকে না। এমনকি একজন সাধারণ মানুষ আজিজ মাস্টার অনেকটা ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের আরেফ অালী মাস্টারের মতো হতে চেয়েছে অস্তিত্ববান। আরেফ আলী মাস্টারের কাছে যেমন একজন মানুষের অকারণ মৃত্যু বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তেমনি আজিজ মাস্টারের কাছেও তাঁরই ছাত্রী কোহিনুরের মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় প্রশ্নের। এভাবে একজন মেয়ে যে কি-না আলো ছড়ানোর জন্য পৃথিবীতে এসেছে অথচ সেই-ই চেয়ারম্যানের (নুরুল মোল্লা) সন্তান রাকিবের কাছে হেনস্তার শিকার হয় আর বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষনের শিকার হয় চেয়ারম্যান (রাকিবের পিতা) নুরুল মোল্লার।
মাস্টার আজিজ অনেকটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্পের নুরুল হুদার মতো ভীতু প্রকৃতির লোক ছিলেন। নুরুল হুদা যেমন শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর রেইনকোট গায়ে জড়িয়ে ভীতির কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন এবং দেশের সব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতাবোধ করেন অনুরূপ কবি আসাদের সংস্পর্শে এসে আজিজ মাস্টার নিজেকে করে তোলেন সাহসী। তিনি প্রতিবাদ হিসেবে গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। কবি আসাদ বলেছেন প্রেসক্লাবের সামনে গায়ে আগুন দেবার কথা ঘোষণা করলে হয়তো তিনি নুরুল মোল্লাকে বিচারের আওতায় আনতে পারবেন এবং জনগণ তাকে মরতে দেবে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘লালসালু ‘ উপন্যাসে দেখিয়েছেন এ সমাজে একবার যদি কেউ মরণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সমাজ তাকে মরণের সব উপকরণ জোগিয়ে দিবে। ‘মরণোত্তম’ উপন্যাসেও কামরা অনুরূপ বিষয় দেখতে পাই। আমরা দেখেছি সাধারণ মানুষ একজন মানুষের মৃত্যুকে কেমন স্বাভাবিক ধরে নিয়ে ফেসবুকে লাইভ দেখাচ্ছেন আবার কেউবা সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত আবার কেউবা আজিজ মাস্টার গায়ে কখন অাগুন দিবেন সেটা নিয়ে চিন্তিত, কারণ মানুষের সময়েরও তো একটা দাম আছে! এখানে মানুষের সাধারণ চরিত্র ঔপন্যাসিক দক্ষতার সাথে তুলে ধরতে পেরেছেন।
উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি আজিজ মাস্টার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছেন। তারপর জনতা এটা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। দেশের সব মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। অথচ এই মানুষেরা ইচ্ছে করলেই আজিজ মাস্টারকে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু মানুষের মন বড় আজব একটা চিজ, লাশ না পেলে তাদের আন্দোলন জমে না; রাজনীতিবীদদের রাজনীতির রসদের জোগান হয় না। শুরু হয় রাজনীতি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সঠিক বিচার পান অাজিজ মাস্টার, তাঁর স্কুল ‘দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুল’ এমপিও হয় পাশে আরেটি কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং শোনা যায় সরকার তাঁকে মরণোত্তর কোন একটা পুরস্কার দিবেন। এখানে কবি আসাদ একটা আয়রনি সহযোগে বলেছেন, ‘‘যেখানে জীবনের চেয়ে মৃত্যু উত্তম। মরণই উত্তম। জীবিত মানুষটির চেয়ে মৃত মানুষটি যেখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে মরণই তো উত্তম। কি, উত্তম না?’’
শেষ পর্যন্ত একটা চরম ভাবাবেশ ছড়িয়ে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। মানুষের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে একজন মানুষের বিদায়, যে এই পৃথিবীর রঙ্গে-রূপে আরো কিছুদিন বাঁচতে চেয়েছেন অথচ তাঁকে কীভাবে আমরা সবাই মিলে মেরে ফেললাম। যা-ই ঘটুক না কেন ‘মরণোত্তম’ শেষ পর্যন্ত মরণ জয়েরই কাহিনি; মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শত মানুষকে জাগানোর কাহিনি।
এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ (একুশের বইমেলা ২০২০)
মুদ্রিত মূল্য: ২২৫ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৪
গ্রন্থের ধরন: উপন্যাস