মরণ বিলাস: মৃত্যু পথযাত্রীর চূড়ান্ত অনুভূতি।
প্রখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ অাহমদ ছফা রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘মরণ বিলাস’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় অাশির দশকের ক্রান্তিলগ্নে। অাহমদ ছফার লেখনী বরাবরই গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করেছে। মরণ বিলাস এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির মৃত্যু পূর্ব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নিয়ে লেখা গ্রন্থটি। সরকারের মৃত্যুপথযাত্রী মন্ত্রী ফজলে এলাহী ও তার সহকারী মাওলা বক্সের কথোপকথনে বর্ণিত হয়েছে মৃত্যুর পূর্ব অনুভূতি। লেখক ছফা’ ফজলে এলাহীর জবানীতে তুলে ধরেছেন এ চরম অনুভূতি ।
মানুষ মরবার পূর্বে এমন একটা অনুভূতিশক্তির অধিকারী হয়, তার এমন একটা দিব্যদৃষ্টি জন্মায়, সারাজীবনের ভালোমন্দ সব ধরনের কর্ম, তার সামনে মিছিল করে এসে হাজির হয়।লোমকুপেও দৃষ্টিশক্তি জন্ম নেয়। প্রতিটি জিনিসকে অন্তর্গত পরিচয়ে চিনতে পারে। বিগত জীবনের কর্মরাশি চারপাশে কারাগার রচনা করে থাকে। মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর চেয়েও অধিক কষ্ট দেয় এই চেতনা।
মন্ত্রী ফজলে এলাহী ও হয়েছিলেন এ দিব্যদৃষ্টিপ্রাপ্ত। মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে প্রতিবিম্বিত হয়েছিল তার জীবনের কৃতকর্মসমূহ। সরলচিত্তে সহকারী মাওলা বক্সের সাথে বর্ণনা করছিলেন তার অনুভূতিগুলো। চাটুকার মাওলা বক্স তাকে অাশান্বিত করার জন্য স্তুতি গেয়ে যাচ্ছিলেন। মন্ত্রী ফজলে এলাহী কালানুক্রমিকভাবে বিবৃতি করে যাচ্ছেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কৃতকর্মসমূহ।
ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের সন্তান ফজলে এলাহী। ছোটবেলা থেকেই ছিলো পিতার অবাধ্য। সেই বাল্যকালে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিলেন সৎভাইকে। রেঙ্গুন প্রবাসী চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে জড়িয়েছিলেন গভীর প্রণয়ে। দীর্ঘদিনের প্রণয় অার মিলেনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে অাত্নহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই নারী। স্কুল জীবনে অসৎ সঙ্গ পেয়ে জড়িয়ে ছিলেনে নানা অপকর্মে। জ্বালিয়ে দিয়েছেন হেডমাস্টারের বসতবাড়ি। অগ্নি দহনে দগ্ধ করেছেন হেডমাস্টার ও তার সহায়সম্বল। ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন মাওলা বক্সের কাছে। ভিমরুলের চাকে খোচা দিলে যেমন তাবৎ ভিমরুল বেরিয়ে অাসে, ফজলে এলাহীর জীবনের শেষরাতে তেমনি বেরিয়ে অাসছিলো তার অপকর্মের বিবৃতি। মন্ত্রী ফজলে এলাহী মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে নিজেকে পশুতুল্য বোধ করেছেন। তবে তিনি অনুতপ্ত নন তার কৃতকর্মের জন্য। তার ধারণা মানুষের বিচার কখনো মানুষ করতে পারেনা।
তবে তিনি এটা বিশ্বাস করেন, মানুষের কর্ম অার চেতনায়-ই মানুষ। নাম তো শুধুমাত্র কতিপয় শব্দ অার ধ্বনির সমষ্টি। হাত পা, রক্তমাংস তো মৃত্যুর সাথে সাথেই কার্যকারিতা হারাবে।
সহকারী মাওলা বক্স প্রথমে তার প্রশংসা অার তোষামোদ করলেও পরবর্তীতে তার ভাবান্তর ঘটে । মন্ত্রী সাহেবের অপকীর্তির বর্ণনা শুনতে তিনি অসহ্য বোধ করেন। ঘৃণাভরা স্বরে মাওলা বক্স বললেন, মানুষ মানুষের কথা শুনতে পারে, ধৈর্য্য থাকলে পশুর কথাও শুনতে পারে তবে মনুষ্যসন্তান যখন পশুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তাকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়।
রাতের অবসান ঘটতেই মন্ত্রী ফজলে এলাহীরও জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তের অনুভূতি ব্যক্ত করে পারাপারে পাড়ি জমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ফজলে এলাহী। অঢেল ক্ষমতা অার দাপট রুখতে পারেনি মন্ত্রীর মরণযাত্রা। মরণ বিলাস করেছেন অন্য সকল সাধারণের ন্যায়।
লেখকঃ
মোঃ অারিফুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।