এপিএস বুক রিভিউঃ বইয়ের নাম- “কবি”
লেখক- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ধরণ- উপন্যাস
পৃষ্ঠা- ১৪৩
মূল্য-১০০ টাকা
প্রকাশক- বাংলাদেশ-অবসর প্রকাশনী কর্তৃক-হীরকজয়ন্তী সংস্করণ।
রিভিউয়ারঃ নাহিদ শাহীন
লেখকঃ পরিচিতঃ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্মেছেন-১৮৯৮ সালে বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে। মৃত্যু-১৯৭১ সালে। উত্তর কলকাতার নিমতলা শ্মশানে মরদেহে মুখাগ্নি প্রদান ও দাহ।
এই একটি উপন্যাস তাকে খ্যাতিতে আকাশচুম্বী করেছে। উপন্যাস হিসেবে “কবি” হয়েছে অবিস্মরনীয়, কালজয়ী।
কাহিনীর সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ কুখ্যাত অপরাধপ্রবণ ডোমবংশজাত সন্তানের অকস্মাৎ কবি হয়ে উঠার গল্পই “কবি”র মূল পটভূমি। প্রধান চরিত্র নিতাইচরণ, কবি-র নায়ক। নিজেকে কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে স্বপ্নে বিভোর এক যুবক। প্রাচীন সমাজের সংস্কৃতির মহাকাব্য কবি গানের হাতে খড়ি হওয়ার প্রথমদিনেই খ্যাতিমান ওস্তাদ মহাদেব নিতাইচরণকে গানে গানে নগন্য ভেবে তাচ্ছিল্য করে বলে,” আঁস্তাকুড়ের এঁটোপাতা-স্বগ্গে যাবার আশা- গো!
বুকের গহীনে ওই জ্বালা, অবজ্ঞা, অপমানের আগুন পুষে নিতাইচরণ এগিয়ে যায় কবি গানের ভঙ্গুর অসমতল পথ ধরে। তাকে কবিয়াল হতেই হবে, পণ তার রক্তে মিশে। চলমান গানচর্চার বাঁকে হৃদয়ে হঠাৎ প্রবেশ ঠাকুরঝির। উপন্যাসের নায়িকা। পনের ষোল বছরের একটি কিশোরী। মেয়েটির রঙ কালো, কিন্তু দীঘল দেহভঙ্গিতে ভুঁইচাপার সবুজ সরল ডাঁটার মতো অপরূপ শ্রী। ঠাকুরঝিকে প্রথম দেখে চোখ ফেরাতে পারেনা নিতাইচরণ। ঠাকুরঝিকে মোটা সুতার খাটো কাপড়খানির আঁটোসাঁটো বেষ্টনীর মধ্যে তার ছিপছিপে কালো দীঘল দেহখানির স্বাভাবিক খাঁজগুলিকে প্রকট করে যেনো একটি পোড়ামাটির পুতুলের মতো দেখায়। মেয়েটি নিতাইচরণের প্রানের বন্ধু রাজা’র শ্যালিকা, পাশের গ্রামের বধূ। রোজ এসে দুধ দিয়ে যায় নিতাইচরণকে, বিক্রি করে। দিনে দিনে ঠাকুরঝির প্রতি আত্মার টান বাড়ে, ঠাকুরঝিকে নিয়ে নিত্য নতুন গান ভাঁজে। ভেতরে ঠাকুরঝির অস্তিত্ব অনুভব করে, এটিই নিতাইচরণের ভালোবাসা। নিতাইচরণের নব্য কবিয়াল হৃদয়ে প্রেমের হাওয়া, ঠাকুরঝি তার হৃদয় হরণ করে। নিতাইচরণ গান বাঁধে,” ও আমার মনের মানুষ গো! তোমার লাগি পথের ধারে বাঁধলাম ঘর!
ছটায় ছটায় ঝিকিমিকি তোমার নিশানা, আমায় হেথা টানে নিরন্তর।”
প্রেম তার সহে না জীবনে, স্থীয়ত্বকাল অল্প। ঠাকুরঝি নিতাইচরণের প্রেমেও যে বোধবুদ্ধিহীন পাগল হয়ে যায়,স্বামীর সংসারে সে প্রভাব পড়লে একদিন নিতাইচরণের বন্ধু রাজার বউ বোন ঠাকুরঝি সমাজের মুখে চুনকালি লাগায়- নিতাইচরণকে তিরস্কার করে, অপমান করে, লাঞ্চনা করলে- নিতাইচরণ ঠাকুরঝির সুখের কথা ভেবে ভুলতে চায় ঠাকুরঝিকে। কিন্তু ভুলা কি যায়!
এমনই গভীর ক্ষত নিয়ে নিতাইচরণ যখন দিকভ্রান্ত তখন তার বন্ধু রাজা নিয়ে এলো ঝুমুরের দল। এ দলটি পাড়ায় পাড়ায় মেলায় মেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ গান করে। সে দলেই আসে বসন অর্থ্যাৎ বসন্ত, উপন্যাসের অন্য এক মূল্যবান কেন্দ্রীয় চরিত্রের তরণী। একটি দীর্ঘ কৃশতনু গৌরাঙ্গী মেয়ে। অদ্ভুত দুইটি চোখ। বড় বড় চোখ দুইটার সাদা ক্ষেতে যেনো ছুরির ধার,- সেই শানিত- দীপ্তির মধ্যে কালো তারা দুইটা কৌতুকে অহরহ চঞ্চল। এমন মধুপ্রমত্ত দুইটা কালো পতঙ্গ – মরণজয়ী দুইটা কালো ভ্রমর যেনো নিতাইচরণের সামনে এসে দাঁড়ায়। মন সে তো কথা মানে না জাত জাতী খোঁজে না। হায়রে নিতাইচরণের কবিয়াল প্রেমিক মন, বোধ হয়ে যায় বসন্তের প্রেমে।
নিতাইচরণ তার এলাকা ছেড়ে বসন্তের টানে ঝুমুরদলে গান গাইতে চলে যায় এক সময়। মেলায় মেলায় জায়গায় জায়গায় গান গেয়ে নিতাইচরণ হয় পরিচিত প্রসিদ্ধ। কবি হতে হতে বসন্তের প্রেমে মজে পাকা কলা হতে থাকে। বসন্তের জন্য একের পর এক গান গড়ে, শুনায়, ” করিল কে ভুল, হায় রে! মন- মাতানো বাসে ভরে দিয়ে বুক, করাত-কাঁটার ধারে ঘেরা কেয়াফুল।” নিতাইচরণকে এভাবেই করাতে কেটে ফালিফালি করে বসন্তও একদিন মৃত্যুর আমন্ত্রণে এ জগৎ ত্যাগ করে। গঙ্গাতীরবর্তী শ্মশানে বসন্তের মরদেহ দাহ করে নিতাই। বিপর্যস্ত মর্মাহত নিতাইচরণের মধ্যে ভর করে গভীর বিষন্নতা। নিতাইচরণের ভেতর পুড়ে, বুক ভাঙে, যাতনার দহন তাকে ছাই করে। এ জীবনে তার ভালোবাসা সয়না প্রানে। আত্মায় গেঁথে প্রেমের সে চিরন্তন বানী, ” এই খেদ আমার মনে মনে। ভালোবেসে মিটলো না আশ- কুলাল না এ জীবনে। হায়, জীবন এতো ছোট কেনে? এ ভুবনে!”
তারপর নিতাইচরণ দিকভ্রান্ত হয়, চলে যায় অচেনা নতুন জায়গায়, সেখানেও মন টিকেনা। চলে আসে প্রিয় বন্ধু রাজার কাছেই। এখানে সব কিছু ঠিকঠাক আছে, আগের মতো। চকচকে রেললাইন, বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুল, যে কৃষ্ণচূড়া গাছ, যেখানে বসে গান বেঁধেছে কতো রকম, সেই কৃষ্ণচূড়া গাছও আগের মতোই আছে কেবল তার ঠাকুরঝি নেই। ঠাকুরঝিও পৃথিবী ত্যাগ করেছে, পাগল হয়ে ঠাকুরঝি মরেছে। যে ঠাকুরঝির হৃদয়ে তার অর্পিত ভালোবাসা এখনো জীবন্ত, ভালোবাসা চিরন্তন। সে ঠাকুরঝিও পৃথিবী ছাড়লো! বন্ধুর মুখে একথা শুনে বুকের ভেতর তুফান উঠে, চোখের জল বাঁধ মানে না, চোখ ফেটে জল আসে নিতাইচরণের। পরে চোখ মুছে বিচিত্র হাসি হেসে নিতাইচরণ বন্ধু রাজাকে বলে, গান শোন রাজা, গান শোন–“এই খেদ আমার মনে___
ভালোবেসে মিটলো না সাধ,
কুলাল না এ জীবনে!
হায়__ জীবন এতো ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
নিতাইচরণের চোখ থেকে আবার অনর্গল ধারায় জল পড়তে আরম্ভ করলো। কান্নার মধ্যেই আবার তার মুখে হাসি ফুটে। না — ঠাকুরঝি মরে নাই, সে যে স্পষ্ট দেখছে, ওই যেখানে রেলের লাইন দুটো একটি বিন্দুতে মিলে বেঁকে চলে গিয়েছে দক্ষিণ মুখে নদী পার হয়ে সেখানে মাথায় টুপুর দেয়া একটি কাশফুল হিলহিল করে দুলছে, এগিয়ে আসছে যেনো! সে আছে, আছে। এখানকার সমস্ত কিছুর সঙ্গে সে মিশে আছে। এই কৃষ্ণচূড়ার গাছ। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো–এইখানে বসন্ত এসে প্রথম দিন শুয়ে বলেছিলো– কই হে! ওস্তাদ না– ফোস্তাদ! চকিতের মতো মনেও হলো বসন্তও যেনো শুয়ে আছে! আঃ! ঠাকুরঝি, বসন্ত–দু’জনে যেনো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
কবি নিয়ে পন্ডিত জ্ঞানী জন, প্রসিদ্ধ সাহিত্য সমালোচক বৃন্দ বহু সমালোচনা লিখেছেন। অদ্যবদি সে আলোচনা সমালোচনা চলমান। সাহিত্য জগতে “কবি” অপ্রতিদ্বন্ধি এর বিকল্প বাক্য অর্থ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হতে পারে না। আমি নগন্য সাহিত্য প্রেমী এমন দুঃসাধ্য সাহস দেখাতে পেরেছি কেবল মাত্র কবি-র প্রতি আসক্তি, ভালোবাসায় টইটম্বুর হয়েছি বলেই। সহজ করে ছোট্ট পরিসরে “কবি”র রিভিউ উপস্থাপন করলাম, শুধুমাত্র যারা সাহিত্য ভালোবাসেন তারা সময় নষ্ট করে পড়লে আমার সার্থকতা।
রিভিঊয়ারঃ নাহিদ শাহীন, আইনজীবী ও লেখক।