এপিএস বুক রিভিউ
রিভিউয়ার: এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
আমার দেখা নয়া চীন
শেখ মুজিবুর রহমান
‘‘চোখের দেখায় নয়, মনের দেখায় আলোকিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’’
মাত্র ২৫ দিনের সফর। ২৫ দিনের কাহিনি বা ভ্রমণ বৃত্তান্ত গ্রন্থটিতে বর্ণিত হয়েছে। ১৯৫২ সাল। চীনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এক শান্তি সম্মেলনে। এই সম্মেলনে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধির ন্যায় তিনিও গিয়েছিলেন। গ্রন্থটির বিশেষত্ব- গেলাম, দেখলাম ধরনের নয়। প্রত্যেক বিষয় অবলোকন ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই এক দুরূহ ব্যাপার ছিল; কিন্তু বঙ্গবন্ধু কত সাবলীলভাবে তা উপস্থাপন করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেগ করে।
আজ চীন এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি। কিন্তু সেটা যে হবে তা অনেক আগেই শেখ মুজিবুর রহমান টের পেয়েছিলেন। লেখকের মনের চোখ এবং দূরদৃষ্টি এখানেই প্রতিভাত হয়। চীন কেন এগিয়ে যাবে; কেন সে বিশ্বের মাঝে শক্তির এক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে সেটা সে দেশের শাসক ও জনগণের সাথে কথা বলেই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন এবং তা আজ সত্যে পরিণত।
বঙ্গবন্ধু মানুষের রাজনীতি করেছেন; মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। মানুষের দুঃখ-দৈন্য দূর করে এক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। এজন্য পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর চরিত্র বিচার ও চীনের শাসকের চরিত্র বিচার করে অনেকটাই হতাশ হয়েছেন। কিন্তু ঘরের খবর পরকে জানিয়ে আমরা যে আনন্দ উপভোগ করি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সম্পর্কে সেরকম কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। কারণ তিনি মনে করেন নিজের দেশের দুর্নাম করলে দেশকে ছোট করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ইচ্ছে করলেই পাকিস্তানি শাসকের অপশাসন শান্তি সম্মেলনে উপস্থাপন করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখানেই তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’; এখানেই তিনি এক মহান নেতা।
বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়ে সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সেখানকার মানুষের জীবন-যাপন প্রণালী, তাদের শিক্ষা পদ্ধতি, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাপনা এবং সব কাজে জনগণের অংশগ্রহণ লক্ষ করেছেন। তিনি মনে করেন মাত্র তিন বছরে চীন যে উন্নতি করেছে তা তৎকালীন পাকিস্তানেও সম্ভব হতো যদি শাসকের সদিচ্ছা থাকতো! চীন কীভাবে এগিয়ে গেল এবং কোন কোন বিষয়ে তারা গুরুত্ব দিয়েছে সে সম্পর্কে লেখকের চমৎকার বিশ্লেষণী মতামত এই গ্রন্থে রয়েছে।
কমিউনিস্ট শাসিত চীনে শাসকেরা প্রথমে চাইলেন দেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি উচ্ছেদ করতে। এজন্য তারা প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলেন যারা ভিক্ষা করে, কেন করে? এবং কী উপায়ে তাদেরকে পুনর্বাসন করা যায়? প্রথমে তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা হলো এবং যারা কর্মক্ষম নয় তাদের সরকার থেকে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা সত্তেও যেসব এলাকায় ভিক্ষুক দেখা গিয়েছে জনগণ তাদের ধরে সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। কোনো আইন করে নয়; বরং জনসচেতনতাই এক্ষেত্রে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
চীন একটা সময় আফিমের দেশ বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু সরকার চাইলেন কেউ আর আফিম খেতে পারবেন না। সরকার জানেন আইন করে এটা বন্ধ সম্ভব হবে না। এজন্য জনগণকে সরকার প্রথমে বোঝান এবং জনগণের সহায়তায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর দোভাষী বলেন-‘‘বোঝেন তো, যুগ যুগ ধরে এই অভ্যাস চলে এসেছিল আমাদের দেশে। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের আফিম দিয়ে ঘুম পাড়াইয়া এই সোনার দেশেটাকে শোষণ ও শাসন করেছে। আর এই বিদেশিরা আফিম ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা অর্থ উপার্জন করে নিয়া গিয়াছে। আর আমাদের দেশের গরিব সর্বস্ব বিক্রি করে শুধু আফিম খেয়েছে। আমাদের সরকার ও আমাদের শিক্ষিত সমাজের প্রতিজ্ঞা, একজনও আফিমখোর রাখবো না এই দেশে।’’
একটা সময় চীন বিখ্যাত ছিল ডাকাতির জন্য। চিয়াং কাইশেকের সময় এই ডাকাতির প্রবণতা আরো বেশি হয়। কেন লোকজন ডাকাতি করে সে বিষয়ে সরকার প্রচুর স্টাডি করে বুঝতে পারে বেকারত্ব এক্ষেত্রে দায়ী। সরকার তাদের বেকারত্ব দূর করে ডাকাত জাতির দুর্নাম দূর করে। বঙ্গবন্ধু বলেন-‘‘এক কথায় জনগণ সাহায্য করলে সকল কিছু করাই সম্ভব। শুধু জুলুম করে ও আইন করে এই সমস্ত অন্যায় কাজ বন্ধ করা যায় না, এর সাথে সুষ্ঠু কর্মপন্থারও প্রয়োজন।’’
ভূমি মালিকানার সংস্কারে চীন সরকারের একটা বড় অবদান ছিল। যাদের প্রচুর জমি আছে তাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে তা বিলিয়ে দেওয়া হয় সাধারণ চাষিদের মধ্যে। ফলে কোনো অনাবাদি জমি আর পড়ে রইলো না। ফলে উৎপাদন বেড়ে গেল এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথে চীন এগিয়ে গেল। লেখক বলেন-‘‘নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙল যার জমি তার’ এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে।’’
কৃষক যে উৎপাদন করেছে সরকার তার জন্য সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এই নির্ধারিত দামের কম বেশি কখনোই হতো না। কারণ কেউ দাম বেশি নিতে চাইলে জনগণ তাকে ধরে সরকারের হাতে তুলে দিত। এর ফলে কেউ আর সাহসী হতো না এরকম অন্যায় করতে। তাছাড়া প্রত্যেকটি জায়গায় সরকার কিছু নির্দিষ্ট দোকান করে দিয়েছিল সেখানে সবকিছু সঠিক এবং কমমূল্যে পাওয়া যেত।
ঘুষের ব্যাপারে চীনের বেশ বদনাম ছিল। কিন্তু নয়া চীন সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে এই ঘুষ প্রথার উচ্ছেদ করেছেন। চীনে যারা ঘুষ খেত তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হতো এবং তাদের মুখে সবাই থুতু ছিটাতো। তাছাড়া এই ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছিল বলেই সমাজ থেকে এই ব্যধি দূর করা সম্ভব হয়।
হোয়াংহো নদী চীনের দুঃখ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু সরকারের ডাকে জনগণ নেমে পড়লো বাঁধ দেওয়ার কাজে। জনগণের মধ্যে এধরনের কাজ করার প্রেরণা আসলো কীভাবে সে বিষয়ে লেখক বলেন,-‘‘চীনারা আগে কোনোদিন এই বাঁধ বেঁধে রাখতে পারে নাই। কিন্তু বিপ্লবের পর দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতির দৃঢ়তায় চীনারা অসাধ্য সাধন করেছে।’’
বেশ্যাবৃত্তির জন্য চীন একটা সময় গোটা পৃথিবীতে খুব নামকরা ছিল, বিশেষ করে সাংহাই শহরে এর মাত্রা আরো বেশি ছিল। বিপ্লবী সরকার এই বেশ্যাবৃত্তি দূর করার জন্য প্রথমে একটা কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয় এবং তাদের এ পেশায় আগমনের কারণ ও কীভাবে এই পেশার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সম্ভব সে বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা নেয়। কারণ হিসেবে দেখা যায় অভাব, প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে বের হওয়া ও পরে প্রেমিকের পলায়ন ও উপায় না পেয়ে এ পেশায় জড়িয়ে পড়া এবং আরেকটা কারণ বিয়েতে প্রচুর টাকার প্রয়োজনীয়তা। সরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি ও এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের সাথে বারবার কথা বলে, তাদের উপার্জনের জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে ৬০ ভাগ মহিলা এ পেশা থেকে মাত্র তিন বছরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়।
অনেকেই বলে থাকেন কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থায় মানুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারেন, সরকার এ বিষয়ে তাদের কখনো বাধা দেয়নি। তিনি দেখতে পান চীনে ধর্মীয় গোড়ামি বন্ধের জন্যে প্রত্যেকটি ধর্মের সংস্থা রয়েছে এবং এ সংস্থার মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত নির্যাস যাতে সবাই পায় সেই ব্যবস্থাও করেছে।
চীনের মানুষরা খুব পরিশ্রমী। তাদের কাছে সহজ উপায়ে পয়সা উপার্জনের চেয়ে কাজের মাধ্যমে পয়সা উপার্জন শ্রেয় বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া সঠিক শিক্ষা, থাকা-খাওয়া ও মেধার বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ চীন সরকার করতে পেরেছেন বলেই চীন আজ পৃথিবীতে সবার কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে একাধিক রাজনৈতিক পার্টি এবং সবক্ষেত্রে মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা থাকে না। চীনের সবকিছু ভালো বলে শেখ মুজিবুরের কাছে মনে হলেও কতিপয় বিষয় তাঁর ভালো লাগেনি। তিনি মনে করেন-‘‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’’
চিন্তার স্বচ্ছতা, যুক্তির সুবিন্যস্ত প্রকাশ এবং ভ্রমণের আনন্দের সাথে সাথে জগৎ ও জীবনের প্রত্যেকটি বিষয়কে দেখার যে অনন্য দৃষ্টি তা বঙ্গবন্ধুর ছিল। তাই ‘আমার দেখা নয়া চীন’ শুধু ভ্রমণ কাহিনি হয়ে থাকেনি বরং তা মানুষের পথ চলার এক আলোকবর্তিকা হিসেবেই থাকবে।
এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
প্রকাশক: বাংলা একাডেমি (প্রথম প্রকাশ: ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২০)
মুদ্রিত মূল্য: ৪০০.০০ টাকা
গ্রন্থের প্রকৃতি: ভ্রমণ কাহিনি
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৯৯