এপিএস বই পাঠপর্যালোচনা
বুক রিভিউয়ারঃ মেহেদী আরিফ
বইয়ের নামঃ ভারতবর্ষ
লেখকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধরনঃ প্রবন্ধ
বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “ভারতবর্ষ” বইয়ে এশিয়া আর ইউরোপকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে বিচার করার প্রয়াস পেয়েছেন। একাকিত্ব যে ভারতবর্ষের সম্পত্তি তা বলতে তিনি দ্বিধা করেননি মোটেও। তিনি কল্পনার চৌহদ্দী পেরিয়ে, বাস্তবতার নীড়ে বসে, মননশীলতার প্রাবল্যে, এটাও উপলব্ধি করেছেন যে, ইউরোপের ইতিহাস কর্মযজ্ঞের ইতিহাস।
“নববর্ষ” নামক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন,”য়ুরোপ ভোগে একাকী, কর্মে দলবদ্ধ। ভারতবর্ষ তাহার বিপরীত। ভারতবর্ষ ভাগ করিয়া ভোগ করে, কর্ম করে একাকী। য়ুরোপের ধনসম্পদ আরাম সুখ নিজের; কিন্তু তাহার দানধ্যান, স্কুলকলেজ, ধর্মচর্চা, বানিজ্যব্যবসায়, সমস্ত দল বাঁধিয়া। আমাদের সুখসম্পত্তি একলার নহে; আমাদের দানধ্যান অধ্যাপন— আমাদের কর্তব্য একলার।” ইউরোপ চাপ দিয়ে দমন করতে চেয়েছে, ভারতবর্ষ বলির পাঁঠার মত চাপ নিতে একসময় ঠিকই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ইউরোপীয় সভ্যতা বিরোধমূলক ঐক্যকে ধারণ করেছে, যেখানে ভারতবর্ষ ধারণ করেছে মিলনাত্মক ঐক্যকে। যদিও সে ঐক্য বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
ইউরোপ দল বেধে কাজ করে সফলতার মুখ দর্শনে ধন্য হয়েছে, ভারতবর্ষ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মাথা ঠোকাঠুকিতে মত্ত হয়েছে। লেখক “বারোয়ারী মঙ্গল” নামক প্রবন্ধে বলেন,”মৌমাছির পক্ষে যেমন চাক বাঁধা য়ুরোপের পক্ষে তেমনি দল বাঁধা প্রকৃতিসিদ্ধ”। ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের বিভক্তিতে একজোট হতে পারেনি কখনও, তাই মনের অন্দরে দ্বন্দ্ব দানা বেধেছে হাজার বার।
ইউরোপ বাস্তবপ্রিয়, ভারতবর্ষ কল্পনাশ্রয়ী। কল্পনার দোলনায় দোল খেতে খেতে ভারতবর্ষ একসময় ঘুমিয়ে গেছে। আমরা ভুল করে মোহনিদ্রায় কিংবা আবেগে বাস্তবতার মুখে কল্পনার লাগাম দিয়ে ঘটনাকে কল্পিত করে তুলি, আর ব্রিটিশরা কল্পনাকে বাস্তবতার চাদোয়ায় আচ্ছন্ন করে তাতে বাস্তবতার সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয়। “অত্যুক্তি” প্রবন্ধে লেখকের ভাষ্য, “আমরা বাস্তব সত্যে কল্পনার রঙ ফলাইয়া তাহাকে অপ্রাকৃত করিয়া ফেলিতে পারি, তাহাতে আমাদের দুঃখবোধ হয় না। আমরা বাস্তব সত্যকেও কল্পনার সহিত মিশাইয়া দিই, আর য়ুরোপ কল্পনাকেও বাস্তব সত্যের মূর্তি পরিগ্রহ করাইয়া তবে ছাড়ে।” ভারতবর্ষ স্বকীয়তা হারিয়ে যতবারই ইউরোপের দ্বারস্থ হয়েছে ততবারই ধাক্কা খেয়েছে। ইউরোপ কলা ঝুলিয়েছে, ভারতবর্ষ ক্ষুধার্ত রামছাগলের মত কলা খাওয়ার চেষ্টায় মেতেছে।
বিলাতি সভ্যতার কদর দারুণভাবে তমসাচ্ছন্ন করেছে ভারতবর্ষকে। তাই ভারতের জনগণ নিজ দেশ, ধর্ম ভুলে গিয়ে বিলাতি সভ্যতাকে ধারণ করার চেষ্টায় নিশিদিন ব্যস্ত হয়েছে, তারা না হতে পেরেছে ভারতীয়, না হতে পেরেছে ইউরোপীয়। বর্তমান সমাজের দিকে নজর দিলে এটা একেবার স্পষ্ট হবে। মামা ইউরোপ থেকে সবচেয়ে কম দামি পারফিউম এনে ভাগ্নেকে দিলেও ভাগ্নে গদগদ করে বন্ধুমহলে বলে বেড়ায়, ” Made in Europe”. অন্যের জিনিসকে সেরা ভাবা আমাদের জাতিগত এক ব্যাধি। নিজের ভাল পাগলেও বুঝে এ উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের যুগে অনেক ভারতীয়দের মধ্যে আসেনি। “বেড়ার ওপারের ঘাস বেশি সবুজ” এই চিন্তা-চেতনা মানুষের নিজস্বতাকে কুরে কুরে খেয়েছে বারবার। লেখক ইউরোপের মতো, কর্মকে জয় করতে চাননি বরং চেয়েছেন কর্মের উপর জয়ী হতে। পরিশেষে তিনি ঈশ্বরের কাছে কায়মনোবাক্যে আকুতি জানিয়েছেন, বাঙালির প্রাণ, মন, ঘর, ভাইবোন যেন এক হয়ে যায়। আমাদেরও আকুতি এমন।
বুক রিভিউয়ারঃ মেহেদী আরিফ, সাবেক শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, এসো আলোকিত হই।