এপিএস বই পাঠ-পর্যালোচনা
রিভিউয়ারঃ এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
কারফিউড নাইট
মূল: বাশারাত পীর
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
‘‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না’’ (এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না: নবারুন ভট্টাচার্য)
কাশ্মীর মৃত্যু উপত্যকারই অন্য নাম। এখানে মৃত্যুর নিশ্চয়তা যতটা সুনিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা ততটাই অনিশ্চিত। লেখক বাশারাত পীর এই মৃত্যু উপত্যকারই অনন্তনাগে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালে। স্কুল জীবনে জল্লাদের উন্মত্ত নৃত্য তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। বার বার মৃত্যুকে কোলাকুলি করেছেন; বারবারই ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। আর এই বেঁচে থাকার স্মৃতিই যেন বিধৃত হয়েছে ‘কারফিউড নাইট’ গ্রন্থে।
‘কারফিউড নাইট’ গ্রন্থটি শুরু হয়েছে লেখকের চমৎকার বর্ণনার মধ্য দিয়ে। যেখানে লেখক বলছেন, ‘‘ এক শীতকালে কাশ্মীরে আমার জন্ম। আমার গ্রাম পর্বতের পাদদেশে দক্ষিণাঞ্চলীয় অনন্তনাগ জেলায়। যেখানে মাটি ও ইটের তৈরি গুচ্ছ বাড়িঘরের চারপাশ ঘিরে গ্রীষ্মের শুরুর সবুজ ধানক্ষেতগুলো শরতে সোনালি রং ধারণ করে। শীতকালে আমাদের ছাদ থেকে সশব্দে তুষার গড়িয়ে পড়ে বাগানে। ছোট ভাই ওয়াজহাত ও আমি মিলে তুষারমানব তৈরি করি এবং কয়লার টুকরা বসিয়ে দিই তুষারমানবের চোখে।’’ বর্ণনায় বর্বরতা বা মানব ইতিহাসের কোনো জঘন্য দৃশ্যের অবতারণা আমরা মোটেই লক্ষ করি না কিন্তু পাঠক যতই বইটির সম্মুখভাগে এগিয়ে যাবেন দেখতে পাবেন কাশ্মীর আসলেই মৃত্যু উপত্যকা ছাড়া আর কিছু নয়।
বাশারাত পীর যৌথ পরিবারে বসবাস করতেন। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন বড় হয়ে তিনি বাবার মতোই ‘ইন্ডিয়ান এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে’ যোগ দেবেন। কিন্তু লেখক সে চিন্তা ভাবনা থেকে প্রথমেই নিজেকে সরিয়ে নেন। কাশ্মীরে গত শতকের নব্বই এর দশকে ভারতীয় সেনা কর্তৃক যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড লেখক প্রত্যক্ষ করেছেন তাতে তিনি দেখেছেন কাশ্মীরের অধিকাংশ যুবক এলওসি (লাইন অব কন্ট্রোল) অতিক্রম করে পাকিস্তান অংশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় ফিরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লেখকের বর্ণনায়, ‘‘প্রায় সব কিশোরের মতো আমিও তাদের সাথে যোগ দিতে চাইলাম। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা ও মৃত্যুবরণ করা পরম আকাঙ্ক্ষার হয়ে ওঠেছিল; কিশোরীর ঠোঁটে প্রথম চুম্বনের মতো।’’
কাশ্মীরের যেসব তরুণ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল তারা প্রায় কেউই আর বাঁচতে পারেনি। হয় প্রতিপক্ষ বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছে নতুবা সেনাবাহিনীর হাতে। লেখক যখন যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তাঁর বাবা বোঝালেন তোমার বয়স এখন চৌদ্দ। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এখনো তোমার অনেক জানার বাকি আছে কিছুদিন পড়াশোনা কর এবং সবকিছু জানার পর যদি মনে হয় তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক তাহলে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যেও। এ সম্পর্কে লেখকের বাবার মন্তব্য স্মর্তব্য, ‘‘কিন্তু এ সম্পর্কে হয়তো আরও কয়েক বছর তোমার পড়াশোনা করা ও চিন্তাভাবনা করা উচিত এবং তারপর তুমি নিজেই তোমার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ওই সময় আমি তোমাকে বলব না যে, কোন গ্রুপে তোমার যোগ দেওয়া উচিত অথবা উচিত নয়।’’
নবারুন ভট্টাচার্যের মতো বাশারাত পীর বলতে পারতেন, ‘‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না’’ কিন্তু তিনি তা করেননি; পড়াশুনার জন্য অন্যান্য যুবকদের মতো তিনিও কাশ্মীর ছেড়েছিলেন কিন্তু সেটা শুধুই পড়াশুনার জন্য। তারপর তিনি দিল্লি গিয়ে পড়াশুনা করে সাংবাদিক হিসেবে ফিরে আসেন কাশ্মীরে। সংবাদ সংগ্রহ করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে তিনি মনে করেননি; বরং ইতিহাসের কানাগলিতে তিনি তন্ন তন্ন করে খোঁজে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ফলে বাস্তবতা ওঠে আসে তার হাতের মুঠোয়।
বাশারাত পীর কাশ্মীরিদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনার প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করেছেন; যারা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন বা পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তাদেরতো বটেই তাছাড়া তাদের ওপর যে ধরনের নির্যাতন হয়েছে সে চিত্রও তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর রচিত ‘কারফিউট নাইট’ গ্রন্থে। যারা বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে তাদের অনেক যোদ্ধার পুরুষত্ব নষ্ট করা হয়েছে; যারা আর বিবাহের সাহস দেখাননি। অনেক নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। ছোট ছোট ছেলেদের জোর করে বিদ্রোহী শিবিরে গ্রেনেডসহ পাঠানো হয়েছে। এক কথায় লোমহর্ষক বাস্তব বর্ণনা দিয়ে মানুষের পাশবিকতার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন।
লেখক শুধু মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার বা নির্যাতনের ফিরিস্তি দিয়েই তাঁর মহান দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছেন এমন কিন্তু নয়! যেসব পণ্ডিত তাদের জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাদের মানবেতর জীবনেরও চমৎকার অথচ করুণ কাহিনি তিনি গ্রন্থটিতে উপস্থাপন করেছেন।
২০০৫ সালে আটান্ন বছর পর ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা এলওসি অতিক্রম করে বাস ভারত থেকে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। ফলে অনেকেই তাদের প্রিয়জনদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেন । লেখকও অংশ নিয়েছেন এই সফরে। তিনি বলেন, ‘‘ যৌবনের প্রারম্ভে যে মনোরম, বিদ্রোহী কাশ্মীর আমি ছেড়ে গিয়েছিলাম তা এখন বর্বরতার শিকার, ক্লান্ত-বিপর্যস্ত এবং অনিশ্চিত মানুষের ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। আমার বয়স এখন ত্রিশের কাছাকাছি, যথেষ্ট বয়স্ক। সংঘাত হয়তো রাস্তা থেকে দূরে অপসারিত হয়েছে, কিন্তু এই সংঘাতের ক্ষত সম্ভবত আত্মা ছেড়ে যাবে না।’’
যে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ দুটি দেশকে বিভক্ত করে সেটা আসলেই কি দ্বিখণ্ডিত দুটি দেশের রেখা না অন্য কিছু! লেখক বলেন, ‘‘এই সীমান্ত রেখা টেনে নেওয়া হয়েছে আমাদের আত্মা, আমাদের হৃদয় এবং আমাদের মনের মধ্য দিয়ে। একজন কাশ্মীরি, একজন ভারতীয় এবং একজন পাকিস্তানি যা বলে, লিখে এবং করে তার সবকিছুর মধ্য দিয়ে টানা হয়েছে এই রেখা।’’
বর্ণনার অভিনবত্ব ও বিস্তৃত পরিসরে মানুষের জীবন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের যে বিশ্বস্ত বর্ণনা গ্রন্থটিতে বিবৃত হয়েছে তাতে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় কতটা নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর সাধনায় বাশারাত পীর এমন একটি স্মৃতিকথা আমদের উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। কাশ্মীরের প্রকৃতি, সেখানকার মানুষ, তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সংস্কার-কুসংস্কার ও সেসবের মনকাড়া বর্ণনা গ্রন্থটির বিশেষ অভিনবত্বের দিক। তাছাড়া অনুবাদ কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সময় ও পরিবেশ উপযোগী ভাষার প্রয়োগ গ্রন্থটিকে করেছে অনন্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে মানুষের চেয়ে মাটি যেমন গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঠিক অনুরূপ ঘটনা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরেও ঘটেছে। তাই মানুষ সেখানে উপেক্ষিত; ভূরাজনীতি সেখানে প্রতিষ্ঠিত।
এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
প্রকাশক: প্রচ্ছদ প্রকাশন (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১৯)
মুদ্রিত মূল্য: ৩৮০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৬৮
গ্রন্থের প্রকৃতি: স্মৃতিচারণ