এপিএস বই পাঠ-পর্যালোচনা
শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি
আবুল ফজল
রিভিউয়ারঃ এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
সাহিত্যিক মাত্রই দেশ, কাল, সমাজ ও সেই সমাজের মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। সেটা ছোট বা বড় যে মানেরই সাহিত্যিক হোন কেন এ দায়বদ্ধতা তিনি এড়াতে পারেন না। আর সে দায়বদ্ধতা থেকেই আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত স্মৃতিকথা ‘শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থটি। আবুল ফজল একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ থাকলেও স্মৃতিকথা রচনায় তাঁর প্রাতিস্বিকতার সাক্ষর অমোচনীয় এবং চির ভাস্বর। তিনি এমন একজন মানুষের স্মৃতিকথা লিখেছেন যিনি বাঙালির সবচেয়ে আপনার জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)।
আবুল ফজল একজন সুসাহিত্যিক এবং অধ্যাপনার জগতেও সুপ্রতিষ্ঠিত একটি নাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যম হিসেবে তিনি প্রবন্ধ সাহিত্যের সহযোগিতা নিয়েছেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর সাথে আবুল ফজলের সরাসরি দেখা ও সত্যিকার পরিচয় হয় দেশ স্বাধীন হবার পরে। কিন্তু ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ এবং ‘কেন্দ্রীয় রাজধানী বনাম পূর্ব পাকিস্তান’ এ দুটি প্রবন্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে আবুল ফজল পরিচিত হয়ে ওঠেন। এবং বঙ্গবন্ধু আবুল ফজলের প্রবন্ধ পাঠে মুগ্ধ হন এবং তা পুস্তিকারে প্রকাশের অনুমতি প্রার্থনা করেন।
বঙ্গবন্ধু আবুল ফজলকে একজন পিতৃতুল্য মনে করতেন এবং সেভাবেই শ্রদ্ধা করতেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদ নিতে অনুরোধ করেন। তারপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবুল ফজলের বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ ঘটে। প্রত্যেকটি সাক্ষাৎকার ছিল আবুল ফজলের কাছে বঙ্গবন্ধুকে চেনার ও জানার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
আবুল ফজল ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন দেশপ্রেমিক ও ন্যায়নিষ্ঠ সত্যবাদী। তাই বঙ্গবন্ধুকে অকপটে দেশ শাসনের ব্যাপারে তাঁর সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতেন। এক্ষেত্রে তিনি যে একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে কথা বলছেন সেটা মনে রাখতেন না এবং মনে রাখার চেষ্টাও করতেন না। কারণ বঙ্গবন্ধু গুণীর কদর রাখতেন। অনেকেই লেখক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপন করলেও বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘আপনাকে তো আমি নিজে থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে বলেছি। আর আজ আপনাকে না জানিয়েই ওই পদ থেকে সরিয়ে দেবো এমন কথা আপনি বিশ্বাস করলেন কী করে?’’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখনই অধ্যাপক আবুল ফজলের দেখা হয়েছে তখনই বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাদরে অর্ভ্যথনা জানিয়েছেন। লেখক যখন ঘরে ঢুকলেন তখন-‘‘বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ আন্তরিকতার সাথে আসসালামু আলায়কুম বলে এগিয়ে এসে আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন।’’
দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল। এরকম অবস্থায় অনেক মন্ত্রী ও ধনীদের সন্তান যখন বিদেশে লেখাপড়ার জন্য চলে যাচ্ছেন তখন লেখক শেখ মুজিবকে বলেন, আপনার সন্তানকে কেন বিদেশে পাঠাচ্ছেন না। তার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘দেখুন, আমার ছেলেদের যদি আমি বিদেশে পাঠাই অন্যেরা কী করবে? দেশের সবার ছেলেমেয়েকে তো আর আমি বিদেশে পাঠাতে পারবো না।’’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো সমাবর্তন হয়নি। সমাবর্তন না হলে ছাত্র-ছাত্রীরা মূল সনদপত্র পায় না। ফলে বিদেশে অধ্যয়নকারী ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সমাবর্তন করার জন্য যখন লেখক বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে এই অনুষ্ঠানে আচার্য হিসেবে যোগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘’এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না, মানাবেও না। অতগুলো শিক্ষিত পণ্ডিতজনের সামনে আমার মতো একজন অল্পশিক্ষিতের পক্ষে কনভোকেশনে সভাপতিত্ব করা-আমি ভাবতেই পারি না।’’
স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং অর্থনীতিক ভিত্তি যখন নড়বড়ে তখন বিলাসিতা করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মোটেই শোভনীয় ছিল না। এমনকি এরকম পরিস্থিতিতে তিনি বেতন নেওয়া থেকেও বিরত থাকেন। লেখকের ভাষ্যে, ‘‘গত পনেরো মাস ধরে তিনি কোনো মাইনে নিচ্ছেন না। কেউই এখন জানে না। প্রচার করেননি কথাটি। স্ত্রীর কিছু আয় আছে, তাতেই সংসার চলে। নাস্তা করে সকাল ন’টায় গণভবনে আসেন আর রাত দশটা-এগারোটায় ফেরেন। দুপুরে খাবার পাঠিয়ে দেন মেমসাহেবা বাড়ি থেকে।’’
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর সব লেখক যখন চুপ রয়েছেন; তাঁদের ওপর যে দায়বদ্ধতা রয়েছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তখন আবুল ফজল লেখেন ‘বিবেকের সংকট’ নামক একটি প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু কী ছিলেন এবং জাতি কী হারালো সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রাবন্ধিক বলেন, ‘‘জাতির কাছে শেখ মুজিবের যেটুকু স্বীকৃতি আর সম্মান প্রাপ্য তা দেওয়া হলে, আমার বিশ্বাস, জাতির বিবেক কিছুটা অন্তত শান্তি ও স্বস্তি পাবে।’’
‘শেখ কামাল: স্মৃতিচারণ’ নামক প্রবন্ধে লেখক বলতে চেয়েছেন শেখ কামাল জাতির পিতার সন্তান হয়েও ছিলেন একজন সাধারণ এবং বিনয়ী মানুষ। খেলাধুলা, গানবাজনায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন; ইচ্ছে করলেই ধনীকন্যা বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে একজন খেলোয়াড়কে বিয়ে করেন। ১৯৭৪ সালে আবুল ফজল ঢাকায় আসেন ছাত্রলীগের একটি সভায় অংশগ্রহণের জন্য। বিমান বন্দরে তাঁকে নেওয়ার জন্য যে যুবক গাড়ি নিয়ে আসেন এবং নিজে ড্রাইভ করে লেখককে অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেন এবং সভা শেষে আবার বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন তিনি আর কেউ নন, তিনিই শেখ কামাল। লেখক বলেন, ‘‘এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোডিং করার জন্য নিজেই ব্যাগটি হাতে নিয়ে কিউর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে বলে কোনোরকম অগ্রাধিকার খাটাতে চাইলো না। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো।’’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন আবুল ফজল। ফলে এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। আবুল ফজল কেন জিয়া সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন সে সম্পর্কে পরিশিষ্ট অংশে আবুল ফজলের ছেলে আবুল মোমেন ‘দায়মুক্তি ও দায়বদ্ধতা: বঙ্গবন্ধু ও আবুল ফজল’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি জানাচ্ছেন আবুল ফজল মূলত বঙ্গবন্ধুর ও চার নেতার হত্যার বিচার করা হবে এই শর্তে জিয়া সরকারে যোগ দেন।
‘শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি’ নামক স্মৃতিকথায় শেখ মুজিব যেভাবে আমাদের ঝাপসা চোখে স্পষ্টরূপে ধরা দিচ্ছেন তা আসলেই অজানা, অচেনা এক বঙ্গবন্ধুর পরিচয়। অজানা এবং অচেনা বঙ্গবন্ধুকে জানার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি সত্যিই কৃতিত্বের দাবি রাখে; সেই সাথে আবুল ফজলের বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে আবিষ্কার, আমাদের বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি শেখ মুজিব চরিত্রের সাহসী মনোভাব অামাদের মানসিক গঠনেও রাখতে পারবে চমৎকার দিকনির্দেশনা।
রিভিউয়ারঃ এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
প্রকাশক: বাতিঘর (পঞ্চম মুদ্রণ: অক্টোবর ২০১৮)
মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১৯
গ্রন্থের ধরন: স্মৃতিকথা