এপিএস বই পাঠ-পর্যালোচনা
বইঃ ঠিকানা (উপন্যাস)
লেখকঃ শফীউদ্দীন সরদার
রিভিউয়ারঃ ফরহাদ আহমেদ
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তি লগ্নের পটভূমিতে রচিত শফিউদ্দিন সরদারের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ঠিকানা’। লেখক তার উপন্যাসের নামের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন নিজেদের অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য আলাদা এক আবাসভূমির যা পরবর্তীতে তাদের স্থায়ী ঠিকানা বলে বিবেচিত হয়েছে। উপন্যাসের মুল পটভূমি ১৯৪০ এর দশক হলেও এখানে নানা ভাবে উঠে এসেছে সেই ১৮৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহের( আযাদী আন্দোলন) থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের নিবিড় পর্যালোচনা।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র
ইমাম হাটির আনোয়ার হোসেন। যার ফার্টক্লাশ এম এ ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও শুধু মুসলমান হওয়ার জেরে প্রশাসনের কোন বড় চাকুরীতে সুযোগ পাওয়া হয়ে উঠছিল না। আফসোস আর পারিবারিক অশান্তির ফলে একদিন বাড়ি ছেড়ে এসে কোলকাতায় কোন এক রেলস্টেশনে শুরু করেন কুলির কাজ। নামটাও ফেলেন বদলে। প্রচুর রাজনীতি সচেতন আনোয়ার এর মধ্যেও রাখেন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে চলা সব খবরাখবর রাখেন। তার বিশ্বাস একদিন মুসলমানরা আলাদা দেশ পাবে সেখানে তাকে আর কেউ অবহেলা করতে পারবেনা। এর মধ্যে ভাগ্যক্রমে রেলস্টেশনে কুলির কাজ করার সময় দেখা হয়ে যায় জনাব এম আর খান মজলিস নামক একজন সরকারি কর্মকর্তার সাথে এবং তার মেয়ে নুরমহল বেগমের সাথে যে স্কুলে পড়ার সময় আনোয়ারের স্কুলের জুনিয়র ছিল এবং তাদের মধ্যে ভালো পরিচয় ছিল। জনাব মজলিসের মধ্যস্ততায় আনোয়ার একটা স্কুলের শিক্ষকতার চাকুরী পায় এইট পাশের সার্টিফিকেট দেখিয়ে কারণ আনোয়ার মনে করত সে এম এ পাশ সেটা জানলে তার এই চাকরিটাও হবে না। আদতে তার একটা কর্ম খুব প্রয়োজন ছিল।
শিক্ষক হিসেবে আনোয়ারের নাম চারদিকে খুব সহজেই ছড়িয়ে পরে খুব সহজে। নুরমহলের সাথে আনোয়ারেরও সেই পূর্ব পরিচয় প্রণয়ে পরিনত হল।ইতোমধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনও শেষ পর্যায়ে। সরকার বিভিন্ন প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন সমাধানের জন্য কিন্তু কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের মনোমালিন্য থাকায় তা সম্ভব হচ্ছেনা। ৪৬ এর দাঙায় এর মধ্য মুসলমানরাও প্রচন্ড মার খেল। মজলিস সাহেব সপরিবারে চলে এলেন পূর্ব বাংলায় সেই ইমাম হাটিতে। ঘটনা চক্রে কিছুদিন বিচ্ছিন্ন হল আনোয়ারের সাথে নুরমহলের সম্পর্ক। কিন্তু দেশে ফিরে সেই স্কুলেই ফিরে পেলেন দূজন দূজনকেই।তাদের আপন ঠিকানায়।
শফীউদ্দীন সরদার তার এই উপন্যাসটি লিখেছেন মূলত দেশ বিভাগ এবং তখনকার সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দাঙায় একচেটিয়া মুসলমানদের উপরে দোষ চাপানোর প্রতিবাদ স্বরূপ। আশা করা যায় পাঠক মাত্ররই এখানে ভিন্ন কিছু চোখে পড়বে। লেখক দেখিয়েছন ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষের পতনের পর থেকে যতগুলো স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে সব গুলোর সূচনা করেছে মুসলমানরা বিরোধীতা করেছে ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়। শুধু ১৮৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহ কয়েকজন নিম্নবর্গের হিন্দুদের দ্বারা শুরু হয়েছিল কিন্তু উচ্চ বর্গীয়রা তার বিরোধিতা কতেছেন এবং নিজেরা বাঁচার তাগিদে সবদোষ চাপিয়েছেন মুসলমানদের উপর। এবং এর ভারও বহন করতে হয়েছে মুসলমানদের।
এ প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক তৎকালীন ভারতীয় কিছু লেখকদের নামও উল্লেখ করেছেন যারা একসময় বৃটিশপূজা অনিবার্য মনে করত শুধুমাত্র যেন মুসলমানরা এদেশে মাথা উঁচু করে না বাঁচতে পারে। বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ এর বাংলা ভাগে ভারতীয় হিন্দুদের দ্বি-চারিতা মূলক আচরণের অপনোদনও করেছেন খানিকটা।
তবে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে লেখকের এই ইতিহাস বর্ণনার ধরণটি উৎকৃষ্ট ছিলনা। মাঝে মাঝে মনে হবে যেন উপন্যাস নয় আসলে একটা ইতিহাস বইই পড়ছি। আরেকটু যত্ন নিয়ে ছোট ছোট অধ্যায়ে সহজভাবে ইতিহাসটা তুলে ধরতে পারলে আরও সুখপাঠ্য হত। আরেকটা বিষয়ে না বললেই নয় এই বইয়ের ডায়লগে অপ্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান। খুব সহজ কথা কাউকে বলতে গিয়ে অতিরিক্ত ঘুরানো প্যাঁচানোর দোষে দুষ্ট যেটা পাঠক মাত্রই লক্ষ করবেন।
সর্বসাকুল্যে, বইটি সবার পড়ে দেখা উচিৎ বলে মনে করি।
রিভিউয়ারঃ ফরহাদ আহমেদ
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।