এপিএস বই পাঠ-পর্যালোচনা
রিভিউয়ারঃ নাজমুস সাকিব খান
“প্রদোষে প্রাকৃতজন” ইতিহাসে ঠাঁই না পাওয়া এক ইতিহাসের গল্প। আমরা জানি, সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের নিয়ে কোনো ইতিহাস লেখা হয় না। সে জায়গা থেকে শওকত আলী তার উপন্যাসে তুলে ধরেন ততকালীন অত্যন্ত সাধারণ নিচু শ্রেণির মানুষ তথা প্রাকৃতজনদের জীবনযাত্রা,জীবন দর্শন এবং তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া শত বছরের শোষণের ইতিহাস। উপন্যাসটি জাতে ঐতিহাসিক হলেও, ইতিহাস বর্ণনা করা এর মূল উদ্দেশ্য ছিল না।
এবার একটু উপন্যাসের শেষ থেকে শুরু করা যাক,
ছোটবেলার ইতিহাস বই পড়ে আমরা এইটুকুই জানতে পারি যে, মাত্র ১৮ জন সৈন্য
নিয়ে বখতিয়ার খলজি বিনা যুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য জয় করে নেন। কিন্তু
বাংলা জয়ের ইতিহাস তো এইটুকু হতে পারে নাহ। তখন সেখানকার জনগণের অবস্থা
কেমন ছিল? বোদ্ধ,ভিক্ষু, সন্যাসীরা কেনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল? এই জয়
তারা কিভাবে নিয়েছিল? লক্ষ্মণ সেনের আমলেই মানুষ কতটা ভালো ছিল?
যে শিল্পী তার শিল্পের মাঝে বেঁচে থাকবার স্বপ্ন দেখেছিল,যে স্ত্রী ভেবেছিল তার স্বামীর সঙ্গেই সুখে জীবনটা কাটিয়ে দেবে, যে সন্যাসী নিজের জীবনটা অন্যদের কল্যাণের মধ্যেই নিবেদনের জন্য সমাজের নিকট মাথা নত করার জন্য প্রস্তুত ছিল,সেই তাদের স্বপ্ন, ভালোবাসা আর নিদারুণ বাস্তবতাই যেনো ফুটে উঠে প্রতিটি চরিত্রে।
শ্যামাঙ্গ, লীলাবতী, মায়াবতী, বসন্তদাস, মিত্রানন্দের মতো অসংখ্য সাধারণ সহজ সরল মানুষ;এই মানুষগুলো সকলেই বড় বেশি সাধারণ কিন্তু তাদের প্রতিদিনের জীবন, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, উত্তর খুঁজে চলা একেকটা প্রশ্ন আমার চোখে তাদেরকে অসাধারণ করে তোলে। ইতিহাস ভাঙা -গড়ার খেলায় বীরদের কে আমরা যেমন মনে রেখেছি তার বিপরীতে সমাজের শোষিত নিচু শ্রেণির মানুষদের অনুচ্চারিত কষ্টগাঁথা কঠিন সত্যটাকে আমরা ভুলে যাচ্ছি। আর শওকত আলী উপরোক্ত চরিত্রগুলোর মাধ্যমে ততকালীন সামন্তদের বর্বর অত্যাচার, অবিচার, শোষণকেই তুলে ধরেন “প্রাকৃতজন” প্রাকৃতজনের প্রতিবাদে।
ইতিহাস প্রাকৃতজনদের ইতিহাসের পাতায় কখনো স্থান দেয়নি। তাদেরকে মেরে ফেলা হয়;তাদের স্বপ্নকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
আবার একটু শুরু থেকে শুরু করি,
গল্পের শুরু হয় শ্যামাঙ্গ নামের একজন মৃৎশিল্পীকে দিয়ে। যার কাজ ছিলো মন্দিরের পুত্তলিকা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। তার ভালো লাগা ও রুচি বোধ ছিলো একটু অন্য প্রকৃতির। যে কারণে তথাকথিত স্টাইলে মূর্তি নির্মাণ না করে সে নিজস্ব স্টাইলে মূর্তি তৈরি করে। কিন্তু জাতে সে নিচু হওয়ায় ব্রাহ্মণদের কাছে তার শিল্পকর্ম টেকে না। এক পর্যায়ে তাকে গুরুর সান্নিধ্য ও বিতারিত হতে হয় এবং ত্যাগ করতে হয় সকল প্রকার মায়াকে…..
লেখক কাহিনি অসমাপ্ত রেখে গেলেও শ্যামাঙ্গের মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছেন, “ তার মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি রেখে আমাদের বলা হয়, হ্যাঁ অনিবার্যই ছিল তার মৃত্যু। তার মতো মৃৎশিল্পীর জীবিত থাকার অধিকার দেয়নি ঐ সময়ের সমাজ-ইতিহাস। ”
কিন্তু একজন শিল্পীর কখনো মৃত্যু হতে পারে না,শিল্পীর দৈহিক মৃত্যু হলেও তার আত্মীক মৃত্যু সম্ভব নয়। একজন শিল্পী বেঁচে থাকে তার শিল্পকর্মে।
লেখকের মতে, “রাঢ,বরেন্দ্র বঙ্গ-সমতটের যেকোনো পল্লী বালিকার হাতে কখনো মৃৎ পুত্তলি দেখতে পান,তাহলে লেখকের অনুরোধ,লক্ষ্য করে দেখবেন ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি না- আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওটি শুধু মৃৎ পুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দীর পূর্বের শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালোবাসাও।
হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ।
রিভিউয়ারঃ নাজমুস সাকিব খান
অর্থনীতি বিভাগ,ইবি
শিক্ষাবর্ষ ২০১৭-১৮