এপিএস-বই পাঠ পর্যালোচনা
বই— Sapiens: A Brief History of Humankind
লেখক— Yuval Noah Harari
রিভিউয়ার– সাকিব সরোয়ার
কে তুমি? কেও যদি আমাকে এই প্রশ্ন করে তাহলে প্রথমেই হয়ত উত্তর দিব— আমি সাকিব। কিন্তু এটাই কি আমার এক্সাক্ট উত্তর হবে? আমি জন্মের সময় অবশ্যই আমার নামটা নিয়ে জন্মাইনি। আমার নাম সাকিব না হয়ে নিপু হতে পারত অথবা ফয়সাল হতে পারত। নাম আমার যাই হোক না কেনো, আমি আমিই থাকতাম। তাহলে আমি আসলে কে? Birds eye view থেকে যদি বলি, উত্তর দিব— আমি মানুষ। এখানেও জটিলতা। কারণ আমার জন্মের লক্ষ বছর আগেও মানুষ ছিলো, এখনও মানুষ আছে। মানুষে মানুষে গায়ের রঙে, উচ্চতায়, শরীরের বাহ্যিক গঠনে ভিন্নতা। তারাও মানুষ, আমিও মানুষ; তবু কেনো এত ভিন্নতা?
এখন, এইসব জটিলতা ও রহস্যের সমাধান পেতে হলে প্রথমেই আমাকে জানতে হবে মানুষের গল্প।
কীভাবে এই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হলো? কিভাবে মানুষের সৃষ্টি হলো? দৈবক্রমে আকাশ থেকে টুপ করে একটা মানুষ পৃথিবীতে এসে তারপর এত মানুষের সৃষ্টি হয়েছে? যদি তাই হতো, তাহলে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের সাইজ কেন? একজন কালো, একজন সাদা কেন? কেও খাটো কেও লম্বা কেন? কেন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য? পৃথিবীতে আমরাই কি একমাত্র মানুষ ছিলাম? আমাদের অন্য ভাই ব্রাদারদের হটিয়ে আমরা কীভাবে টিকে থাকলাম? অন্য মানুষগুলোর কী হলো? কীভাবে মানুষের বিকাশ ঘটল? কীভাবে আদিম মানুষ থেকে বর্তমানের আধুনিক মানুষের বিবর্তন হলো? কীভাবে সেই প্রাচীন সমাজব্যাবস্থা থেকে বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থায় মানুষ এসে পৌঁছালো। এইসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে ইউভাল নোয়া হারারির ‘সেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যানকাইন্ড’ বইতে।
প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্ম। পৃথিবীর জন্মের প্রায় ১০০ কোটি বছর পর পৃথিবীতে থাকা মাল-মশলার ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় প্রাণের সৃষ্টি। সেই প্রাণ থেকে বিবর্তনের ফলে আদি মানুষের আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে। শুধু আমরা হোমো সেপিয়েন্সরাই একমাত্র মানুষ এমনটা নয়। মাত্র দেড় লাখ বছর পূর্বেও পৃথিবীতে ৬ ধরনের মানুষ ছিলো। হোমো সেপিয়েন্সের সাথে হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ার্থান্ডাল, হোমো রুডলফেনসিস এরাও হোমিনিনি গোত্রের প্রাণী ছিলো। বিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে এরা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, অথবা আমরাই এদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। এদের ফসিল এখনও ভূতত্ত্ববিদগণ খুঁজে পাচ্ছেন। ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও আমরা কিভাবে এখনো স্বগর্বে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি?
উত্তর হলো— কমিউনিকেশন সিস্টেম। নিয়ার্থান্ডাল প্রজাতির মানুষেরা হোমো সেপিয়েন্সের চেয়েও উন্নত ছিলো সেসময়। কিন্তু হোমো সেপিয়েন্সের আলাদা যেটা ছিলো সেটা হলো উন্নত কমিউনিকেশন সিস্টেম এবং গল্প বলার ক্ষমতা। ওরা হয়ত খুব বেশি হলে বলতে পারত— ‘বাঘ আসছে, পালাও।’ কিন্তু আমরা সেই সাথে বলতে পারতাম— ‘বাঘ আসছে, সবাই জঙ্গলের আড়ালে যাও, আড়াল থেকে আক্রমণ করা হবে।’ এই কমিউনিকেশন সিস্টেমটাই হোমো সেপিয়েন্সকে আর সবার চেয়ে সেরা করে তুলেছে।
মানব সভ্যতার বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো— গল্প বলার ক্ষমতা।
হোমো সেপিয়েন্স গল্পের মাধ্যমে একটা ইম্যাজিনড রিয়েলিটি ক্রিয়েট করতে পারে। তারপর সেই কল্পনায় বিশ্বাস করে তারা সামনে এগোতে পারে। ধরেন, ভার্সিটিতে ভর্তির আগে আমার পরিবার, বড় ভাই-বোনেরা ভার্সিটি সম্পর্কে হাজারটা গল্প বলেছে। ভার্সিটিতে একবার ভর্তি হয়ে নাও তারপর আর কোনো পড়াশোনা নাই, মেয়েরা তোমার পিছে লাইন দিয়ে ঘুরবে, ইত্যাদি। যদিও এগুলা সত্যি হয়নি [আবার সত্যি হয়ও] তবুও তাদের ক্রিয়েট করা ইম্যাজিনড রিয়েলিটিতে বিশ্বাস করে আমি দিনরাত খেটেখুটে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আল্টিমেটলি আমার কিন্তু লাভ বৈ ক্ষতি হয়নি [অনেক সময় ক্ষতিও হয়]। হোমো সেপিয়েন্স এই কাজটা করতে পারে, যা আর অন্য কোনো প্রাণী করতে পারেনা। আমাদের জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ধর্ম —এই ইম্যাজিনড রিয়েলিটিরই ফসল।
এবার প্রশ্ন হলো— ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য কেনো?
হোমো সেপিয়েন্সদের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের কারণ হলো তার মধ্যে বিদ্যমান জিনের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য। মানুষের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু জিনের মৃত্যু ঘটে না। প্রজননের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের দেহে জিন বাহিত হতে থাকে। আমাদের পূর্বপুরুষদের যেসব জিন আমরা বহন করছি সে অনুযায়ী-ই আমাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। এ তো গেলো বংশগতির জিন। কালচারাল জিন নামে আরো এক ধরনের জিন আছে। এর সুন্দর নাম হলো— Meme বা মিম। চারপাশ থেকে ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে আমাদের অবচেতনে যে বিশ্বাস আমরা ধারণ করি সেটাই হলো কালচারাল জিন বা মিম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্ররোচনায় কিছু মানুষের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখার জন্য এই কালচারাল জিন দায়ী। একটি সফল কালচারাল জিন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলতে পারে।
ধীরে ধীরে একসময় হোমো সেপিয়েন্স কৃষি যুগে পৌঁছালো। প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে বিজ্ঞান যুগে পৌঁছেছে। মানুষের বিকাশের তারপরের ইতিহাসটা প্রায় সবারই জানা। টেকনোলজির ব্যবহার, আধুনিক অর্থনীতি এবং সম্পদের রূপান্তর এখন আমাদের যেখানে এনে দিয়েছে, সেটার সাথে সেই ৭০ হাজার বছর পূর্বে হোমো সেপিয়েন্সের যখন প্রথম বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে তার পার্থক্যটা করলে মনে হবে মানুষের গল্পের শেষ পাতাটা বোধহয় এখানেই। কিন্তু মানুষের গল্প এখানেই শেষ নয়। যতদিন মানুষ টিকে থাকবে মানুষের গল্প লেখা চলতেই থাকবে, অথবা মানুষের ইতিহাসের ইতি ঘটলে, লেখা হবে অন্য কোনো ইতিহাস।
— সাকিব সরোয়ার
অর্থনীতি বিভাগ, ইবি।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ।