বই পাঠ-পর্যালোচনা
রিভিউয়ার-জসিম_উদ্দীন
মৃত্যু প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে অমোঘ সত্য একটি জিনিস। প্রত্যেকটি মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।এই চিরন্তন সত্যটি জানার পরও মানুষ তার স্বার্থের জন্য কত কাজই না করে থাকে!স্বার্থকে সফল করতে গিয়ে যেকোনো খারাপ কাজ করতে গিয়েও মানুষ সামান্যতম দ্বিধার সম্মুখীন হয়না। কিন্তু ঠিক একদিন যখন মৃত্যু মানুষের সামনে এসে হাজির হয়; তখন দুনিয়াতে তার সমস্ত কাজের প্রতিচ্ছবি সামনে ভাসতে থাকে। মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে মানুষ তার দুনিয়াবী সমস্ত ভালোমন্দ কাজের কথা অন্যকে বলতে পারলে নিজের মনকে খুব হালকা মনে করে।মৃত্যুকে খুব সহজে আলিঙ্গন করতে পারে। আর এমন মৃত্যুকে মরণ বিলাস বললে ভুল হবেনা।আহমদ ছফা এমনি একটি কাহিনির অবতারণা করেছেন তার মরণ বিলাস উপন্যাসে।
উপন্যাসের মূল চরিত্রে থাকা ফজলে এলাহি পেশায় একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ;ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী রোগি। রাত ১২:১৩ থেকে ভোর পর্যন্ত মৃত্যুশয্যায় কাতর মন্ত্রী ও তাঁর তোষামুদে সহচর মওলা বক্সের কথোপকথনে মন্ত্রীর ছোটবেলা থেকে যৌবনের সব গল্প উঠে আসে। আর তার সাথে সাথে উঠে আসে এমন এক সমাজের গল্প যেখানে ফজলে এলাহির অনৈতিকতাই উপরে উঠে আসার সিঁড়ি।
রাজনীতির মাঠে প্রভাবশালী মন্ত্রী জীবনের
শেষক্ষণে এসে বুঝতে পারে, সে আসলে কতটা ক্ষমতাহীন। তবুও সে বলে, “পলিটিক্স
করতে হলে বিদ্যেবুদ্ধির চাইতে ঘ্রানশক্তিটা প্রয়োজনই সবচাইতে বেশি। ঐ
বস্তু প্রচুর পরিমাণে আমার মধ্যে ছিল বলেই জীবনে এতদূর প্রতিষ্ঠা লাভ
করেছি।
বাস্তব জীবনে ফজলে এলাহী কখনই একজন ভালো মানুষ ছিলেন না। ছোট
বেলায় বাবার সম্পত্তিতে দুই ভাগ হবে যেনে আপন সৎভাইকে বিষপানে মেরে ফেলতে
সামান্য দ্বিধার সম্মুখীন হয়নি।
আপন চাচাতো ভাইয়ের বউয়ের সাথে
যৌনক্রিয়ার লোভ সামলে উঠতে পারেনি। গড়ে তুলেছিলেন অবৈধ যৌনক্রিয়ার
সম্পর্ক।একপর্যায়ে তার ভাবী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায়।লোক জানাজানির হবার
লজ্জায় অবশেষে সেই নারীকে মরতে হয় গলায় দড়ি দিয়ে।
মরণ বিলাস আহমদ ছফার খুব ভিন্ন ধরনের একটা লেখা। উপন্যাসে মূল চরিত্র ফজলে এলাহিকে বলা যায়, এই সমাজের ফুলে ফেঁপে উঠা ভন্ড রাজনীতিকদের আদর্শ প্রতিনিধি। অথবা উপন্যাসটা একটি আদর্শ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। ব্যক্তিজীবনের আমাদের প্রতিটা মানুষের মধ্যেই রয়েছে একেকটা ফজলে এলাহি। মানুষ সবসময় নিজেকে দেখে আসে একরূপে, জীবনভর সে নিজেকে নিয়ে করে বিলাসিতা। কিন্তু এই বিলাসিতা যখন মরীচিকা হয়ে ধরা দেয় তখন সেটা হয়ে যায় ‘মরন বিলাস।’
তাইতো মন্ত্রী ফজলে এলাহি বলে যায়, “প্রকৃতির সঙ্গে যখন মিলিয়ে দেখি তখন আমি শব্দটির কোন অর্থ খুঁজে পাইনা।আবার মানুষের সঙ্গে,সমাজের সংগে মিলিয়ে বিচার করতে যখন প্রবৃত্ত হই,তখন আমি শব্দটা কি অসাধারন গুরুত্ব সম্পন্ন হয়ে ওঠে,কি অপুর্ব ব্যাঞ্চনা ধারণ করে। আমি কে? আমি কি? গভীরভাবে চিন্তা করে কোনো অর্থ আবিষ্কার করতে পারিনা। কিন্তু যখন কথা বলি,যখন কাজ করি তখন আমার চাইতে সত্য আমার চাইতে বড় কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করিনা। আমি আছি বলেই জগত আছে। আমি শুনি বলেই সংগীত এত মধুর হয়,আমি দেখে পরিতৃপ্ত হই বলে কাননে ফুল ফোটে। আমি না থাকলে কোথায় থাকত তোমার জগত,কি করে বিকশীত হত সংগিতের মাধুর্য! কি কারণে কাননে ফুটত ফুল! সমস্ত সৃষ্টি জগতের সার পদার্থ আমি।
মৃত্যু পথযাত্রী ফজলে এলাহির কথোপকথনে ফুটে উঠেছে এক চমৎকার কথ্যমালা।যা পাঠক হৃদয়ের ভাবনাকে জাগ্রত করবে।খুলে দিবে অন্তর্দৃষ্টি। মানুষের অন্তর আর বাহ্যিকতা কখনো এক হয়না সৃজন করবে এ ভাবনা।সর্বপরি বইটি সবার সুখপাঠ্য হবে বলে মনে করছি।
এপিএস-পাঠ-পর্যালোচনা (বুক রিভিউ)
জসিম উদ্দীন