রাশিব রহমান
একটি বিষয় হয়ত পাঠকদের দৃষ্টিসীমানায় এসেছে যে, শিক্ষানবিস আইনজীবীদের একাংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু কর্মসূচি পালন করেছে। দাবি জানানো হয়েছে, বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে নেয়া এবছরের আইনজীবী নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা উত্তীর্ণদের নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হোক। প্রেক্ষিত: মহামারির কারণে লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
এই শিক্ষানবিস আইনজীবীদের দেখলে আমার এক গল্প মনে পড়ে। গল্পটা শিখেছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে। মুজতবা আলী আমাদের এক গণেশের গল্প শুনিয়েছিলেন। গণেশ ছিল এক অফিসের জুনিয়র এপ্রেন্টিস। কাজ শেখে, মাইনে পায়না। এর ওর ফাইফরমাশ খাটে, আশা কোন একদিন পাকা চাকরি হবে। অফিসে কর্মও খালি হয়। বড়বাবু একে ওকে নিয়োগ দিয়ে দেন। গণেশ তার এপ্রেন্টিসের আঁকশি দিয়ে চাকরি ধরতে পারেনা। এমনি করে বছর তিনেক গেল। গণেশের পরিধেয় ধুতিতে গিট দেয়ার জায়গারও অভাব পড়ে গেল। একদিন বড় সাহেব গুরুতর রিপোর্ট লিখছিলেন। দারোয়ানদের ধর্মঘট থাকায় দরজায় পাহারায় ছিল গণেশ। ওদিকে রাস্তায় এক উন্মাদ ‘বার্থডে স্যুট’ পরে ছুটছে, তার পিছে আরো অনেকে ছুটছে। উন্মাদ এসে সোজা বড় সাহেবের ঘরে ঢুকলো। গণেশ বাঁধা দেয়ার চেষ্টাও করল না। ঘরে ঢুকেই উন্মাদ বড় সাহেবকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চেয়ার দখল করল। শেষ পর্যন্ত থানা-পুলিশে রক্ষা। এরপর এল গণেশের জিজ্ঞাসাবাদের পালা। গণেশের বিনীত উত্তর, “আমি ভেবেছিলুম উনি আমাদের আপিসের সিনিয়র এপ্রেন্টিস। আমি তো জুনিয়র, ওঁকে ঠেকাবো কি করে?” বড়বাবু ব্যাখ্যা জানতে চাইলে গণেশের জবাব, “হুজুর, আমি তিন বৎসর ধরে এ আপিসে এপ্রিন্টিসি করছি। খেতে পাইনে, পরতে পাইনে। এই দেখুন ধুতি। ছিড়ে ছিড়ে পট্টি হয়ে গিয়েছে। লজ্জা ঢাকবার উপায় নেই। তাই যখন একে দেখলুম আমাদের আপিসে ঢুকছেন অবস্তর উলঙ্গ, তখন আন্দাজ করলুম, ইনি নিশ্চয় এ আপিসের সিনিয়র এপ্রেন্টিস। তা না হলে তাঁর এ অবস্থা হবে কেন? এখানে এপ্রেন্টিসি করে করে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে সিনিয়র এপ্রেন্টিস হয়েছেন।”এমন সব শতচ্ছিন্ন ধুতিওয়ালা জুনিয়র এপ্রেন্টিস আদালত চত্বরে প্রায়ই চোখে পড়ে।
শিক্ষানবিস আইনজীবীদের যারা প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা আন্দোলনে গেছেন। তাঁদের নিয়ে আমার কথা নেই, আমার কথা এ নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়েই। আইনে স্নাতক হওয়ার পরও কেন এমন প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইভা এতগুলো পরীক্ষা বসতে হবে? এমন ছাঁটাই প্রক্রিয়ার আবশ্যকতা কী? সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও তার ন্যূনতম যৌক্তিকতা আমরা বুঝতে পারি যে, রাষ্ট্র বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিত করে তাই সে সুবিধাভোগীর সংখ্যা সীমিতকরণে রাষ্ট্রের বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে উপায় নেই। ওকালতি তো সরকারি চাকরি না, বরং স্বাধীন ব্যবসায়। এলএলবি পাশ করাটাই তো তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ আবার কেন ব্যবসায়ের অনুমতিপত্রের জন্য পরীক্ষা নামের এ ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় ঢুকতে হবে?অথচ আইনের মত স্পেশালাইজড প্রফেশনাল ডিগ্রীর অধিকারী চিকিৎসক-প্রকৌশলীরা দিব্যি স্নাতক সম্পন্ন করেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ফরম পূরণ করেই পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইন্টার্নশীপ তাঁদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত থাকে। অথচ আইনের স্নাতকদের শতকরা আশি ভাগই আইন পেশার বাইরে পেশা খুঁজে নিতে বাধ্য হন।এখন প্রশ্ন থাকে আইনজীবির সংখ্যা নিয়ে।
উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশকালে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নামক ছাঁটাই প্রক্রিয়া উৎরোলাম। সুযোগ ছিল কলা, সমাজবিজ্ঞান, আইন ও ব্যবসায় প্রশাসনের যেকোন একটিতে ভর্তি হবার। সুপ্রিম কোর্টে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এক আইনজীবী মামার কাছে জানতে চাইলাম আইনে ভর্তি হব কি না। মামা বললেন, “ বাবারে, দেশে ফকিরের চেয়ে উকিল বেশি।” হয়ত একারণেই পেশাজীবনে প্রবেশপথে এত প্রতিবন্ধকতা। এ বড় সহজ সমাধান।বার কাউন্সিলের যারা হর্তা-কর্তা, এতে তাঁদের সাপও মরল, লাঠিও ভাঙলো না। লক্ষ লক্ষ বেকার ¯স্নাতকের দেশে কয়েক হাজার আইন স্নাতকদের স্বপ্নভঙ্গ কী আর বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে? অথচ, স্নাতক পর্যায়ে আইনের ছাত্রসংখ্যা কত হওয়া উচিত তা বিচারালয়গুলোর অবস্থার নিরিখে নির্ধারণ ও পুণর্নিধারণ করা যেতে পারত।কতজন আইনজীবী লাগবে, কতজন বিচারক লাগবে, কতজন আইনের শিক্ষক লাগবে, কতজন আইনশাস্ত্রবিদ লাগবে রাষ্ট্রের কি সে পরিকল্পনা আছে? থাকলে তার নিরিখেই ছাত্র ভর্তি করা যেত। কেউ কেউ বলবেন পরীক্ষা তুলে দিলে অযোগ্য আইনজীবী তৈরি হবে। আমার কথা একজন অযোগ্য মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করতে পারার কথা না। পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রমে কাম্য পরিবর্তন এনে আইনের সব ছাত্রকেই যোগ্য করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হোক। যোগ্য করতে না পারলে ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কেই বহন করতে হবে। প্রয়োজনে পেশায় প্রবেশের প্রথম দু’এক বছর প্রবেশনারি বিবেচনা করা যেতে পারে। তাতেও আশা থাকে দু’এক বছর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন শেষে একজন তরুণ পূর্ণ আইনজীবী হয়ে উঠতে পারবেন। এসময়কালে বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন আয়োজন থাকতে পারে, যেগুলো উৎসাহপ্রদায়ী ও মানোন্নয়নমূলক, প্রতিবন্ধকতাসৃষ্টিকারী নয়। তার বদলে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা কীভাবে তাঁর পেশাজীবনে দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রমাণ দেয় তা অন্তত আমার বোধগম্য হয়না। না কি পুরোটাই এক মোল্লাতন্ত্রের অধীনতা স্বীকার?
উপাসনালয়ের মোল্লা-পুরুতদের খবরদারিতে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দার এর খোলা রবে চালা হাতুড়ি শাবল চালা!”আইনজীবী হিসেবে পেশাজীবন বরণ করা আইন স্নাতকদের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। তাই ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’ তত্ত্বের বিরুদ্ধে উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ ভেদাভেদ ভুলে, যেকোন বর্ষের আইনের ছাত্র নির্বিশেষে অধিকার আদায়ের লড়াই গড়ে উঠুক তীব্রভাবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।