সর্বস্তরে ‘বাংলা ভাষা’ প্রয়োগের কথা শুধু ফেব্রুয়ারিতেই নয় সারা বছর বলতে হবে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি চলছে। সালাম, বরকত, রফিক জব্বার ভাষা শহিদদেরকে প্রতি বছর ৮ই ফাল্গুন বা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে বিন্ম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি কেননা তাঁদের রক্তের দামে মাতৃভাষা ‘বাংলা’ পেয়েছি। এই দিনে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?’ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে সুর ধ্বনিত হয়। দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-এর স্বীকৃতি দেয়। তাই বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ভিনদেশিরাও এদিন এই গান গেয়ে থাকে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক গৌরবের।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ২১শে ফেব্রুয়ারির পরের দিনই আমরা বাংলাদেশিরা ভুলে যাই বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও শুদ্ধ প্রয়োগ। অনেক সময় না বুঝে স্রোতের বাণে অপ্রয়োগ বা ভুল করে বসি। ১৯৫২ সাল থেকে অদ্যাবধি অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি কিন্তু মাতৃভাষার প্রয়োগে ও বাস্তবতায় অনেক ফারাক দেখি, যা সত্যি ভাষার জন্য জীবন দেওয়া জাতি হিসেবে নিজের কাছে লজ্জিত মনে হয়।
সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের রায়- সবই মাতৃভাষা সর্বস্তরে প্রয়োগের অনূকুলে রয়েছে তারপর ও এখনও মাতৃভাষার ব্যবহার সর্বজনীন করতে পারিনি। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, চীনা, আরবি ও হিন্দি ভাষার ওপরে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার দাবি উঠছে নানা কারণে। কেন বাংলার পাশাপাশি অন্য ভাষা শিখব সে বিষয়ে বিস্তর এখানে লিখতে চাই না। আজকে বাংলা ভাষার ব্যবহারে চেতনা ও সচেতনা কীভাবে নিশ্চিত হবে সে বিষয়ে যৌক্তিকতা ও কিছু বিষয় আলোকপাত করব ধাপে ধাপে।
অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশ সাধারণ জনগণকে সহজে যাতে বোঝানো সম্ভব হয় সেজন্য “আমার ভাষা” নামে সফটওয়্যার চালু করেছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়। যা সত্যিই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও প্রশংসনীয়। ভাষার মাসে এমন উদ্যেগকে আইনপেশা সংশ্লিষ্ট সকলেই সাধুবাদ জানিয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি ও মাননীয় আইনমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থী জনগণ। এ বছরে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে একদিনে উচ্চ আদালতে ১৪৯টি মামলার রায় বাংলা ভাষায় দেওয়া হয়েছে। শুধু ২০২৩ সালে নয় করোনা পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার হার বেড়েছে। তাছাড়া ইংরেজি ভাষার রায় বাংলাতে অনুবাদ করতে সফটওয়্যার ও ইনস্টল করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সংবিধানের এই বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ কার্যকর করা হয়। এই আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, “এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সোয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হবে।”
৩ (২) ধারায় আরও বলা হয়েছে, “উল্লেখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।”
ধারা ৩ (৩) বলছে, “যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
তবে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রুল এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি এ ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। হাইকোর্ট বিভাগের রুলের চতুর্থ অধ্যায়ের ১ নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তগুলোর ভাষা হবে ইংরেজি। তবে পঞ্চম অধ্যায়ের ৬৯ নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ এবং ডিক্রি আদালতের ভাষায় প্রস্তুত করতে হবে। একইভাবে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারায় আদালতের ভাষা নির্ধারণ করতে গিয়ে ১৩৭ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো আদালতের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত অন্য কিছু লিখিতভাবে সম্পাদন করার জন্য অত্র কোর্ট আদেশ যা অনুমোদন করে তা ইংরেজিতে লেখা যাবে।’ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যেকোনো ফৌজদারি আদালতের বিচারিক রায় আদালতের ভাষায় অথবা অন্য কোনো ভাষায়- যা আসামি অথবা তার আইনজীবী বুঝতে সক্ষম সে ভাষায় ঘোষণা অথবা উক্ত রায়ের বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করতে হবে।’ তাহলে বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করতে, ডিক্রি বা আদেশ প্রদান করতে বাধা কোথায়? ঠিক সেটি আলোচ্য বিষয় হতে পারে। অনেক আইন, আইনের ব্যাখ্যা, দৃষ্টান্ত ইংরেজিতে এ রকম যুক্তি অনেকে তুলে থাকেন। সেক্ষেত্রে রায় দেওয়ার সময় ইংরেজির ধারাগুলো বাংলায় অনুবাদ করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বা শুধু রেফারেন্সগুলো বাংলা বা ইংরেজি লেখা যায়।
বাংলা ভাষাকে আদালতের ভাষা হিসেবে শতভাগ চালু না করায় রাষ্ট্রের সব নাগরিক তাদের সাংবিধানিকভাবে পাওয়া মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভাষা না বোঝার ফলে স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হয়েও বিচারপ্রার্থী হয়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে অসহায়ের মতো। যে ভাষায় (ইংরেজি) তার আইনজীবী বিচারকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি তা বুঝতে অক্ষম। বিচারক যে ভাষায় রায় দিচ্ছেন তাও বুঝতে তিনি অক্ষম। এখনো দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। শিক্ষার ক্ষেত্রে, গবেষণা, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ইত্যাদিসহ সরকারের বিভিন্ন অফিসে দাপ্তরিক চিঠি আদান-প্রদান করা হয় ইংরেজি ভাষায়। তাছাড়া বাংলা ভাষা প্রয়োগ ও সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময় আদেশ হয়ে থাকলেও আদেশদানকারী অফিস বা আদালত অনেকক্ষেত্রে সেটি মানেন না। অর্থাৎ খোদ উচ্চ আদালতে পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলা চালু হয়নি এখনও। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমান আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর রায় বাংলা ভাষায় লিখে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা পালন করে গেছেন। অন্যরা কেন পারছেন না?
বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিককালে যে রায়টি ঘোষিত হয় সেটি মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও মাননীয় বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চের লেখা। ‘নিগার সুলতানা বনাম রাষ্ট্র’ শিরোনামের মামলার পুরো রায়টিই দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষা বাংলায়। বহুল আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে প্রণিধানযোগ্য পিলখানা হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তির প্রায় ৩০ হাজার পৃষ্ঠার রায়ের একটি অংশও বাংলায় দেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর বেঞ্চের তিন বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী নিজের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার অংশ বাংলায় লিখেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে। দুজন বিচারপতি নিজেদের সব রায় ও আদেশ দিচ্ছেন বাংলায়।
অন্যদিকে সুপ্রিমকোর্টে অধিকাংশ বিচারপতির ইংরেজি ভাষায় দেওয়া রায় ও আদেশ সাধারণ মানুষের বোধগম্য করাতে তা অনুবাদ করে দেওয়ার চিন্তা করছে সুপ্রিম কোর্ট। এজন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি অনুবাদ সেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন)
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে নিযুক্ত ৯৭ জন বিচারপতির মধ্যে ১০ জন কমবেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন। তারা হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি ড. কাজী রেজা-উল হক, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।
এর মধ্যে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রায় ও আদেশ বাংলায় লিখে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এর পরই আছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। কয়েক বছর ধরে তিনিও সব রায় ও আদেশ বাংলায় দিচ্ছেন। এ দুই বিচারপতি বিভিন্ন রায়ে বাংলায় রায় দেওয়ার যৌক্তিকতাও তুলে ধরেছেন।
সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন ও বাংলা ভাষার দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে দিন দিন বাংলা ভাষার প্রচলন সংকুচিত হয়ে আসছে ও দূষণের মাত্রা বাড়ছে। ২০১২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে এবং বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। বেতার ও টেলিভিশনে বিকৃত উচ্চারণ, ভাষা ব্যঙ্গ ও দূষণ করে অনুষ্ঠান প্রচার না করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং একটি রুল জারি করা হয়। কিন্তু রুলের নিষ্পত্তি হয়নি আজও। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন, “১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩ ধারা এবং ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারা অনুসারে বাংলাদেশ সরকার উচ্চতর ও অধীনস্থ বিচার বিভাগে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আদেশ জারি করতে পারে।”
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৭ই ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ দেন। সকলপ্রকার নামফলকে বাংলা ব্যবহার করতে বলেন। আদালতের আদেশের তিন মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু সে আদেশের বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এক চিঠির মাধ্যমে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়িা)
দেশের সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাতেই কথা ও কাজ চালিয়ে থাকে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও বাংলা সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দাপ্তরিক যোগাযোগ এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের লৈখিক তৎপরতায় ইংরেজি চলছে। এর একটি বড় কারণ ঔপনিবেশিক আমলের মন-মানসিকতা। জাপান, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানির মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়া, তুরস্কের মতো কম প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রয়োজন ছাড়া ইংরেজি ব্যবহার করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না কেন? বাংলা ভাষার নান্দনিক আবেগি শব্দ, গৌরব, বিজ্ঞানসম্মত রচনা শৈলী এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ইতিহাসও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও চর্চার বিরোধী আমরা নই। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ও উন্নতি করতে হলে ইংরেজি ভাষা চর্চা ও উন্নতভাবে শিখতে হবে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অফিসের ভাষা, ইংরেজি ব্যতীত শিক্ষার ভাষা, সাইন বোর্ড, বিল বোর্ডের ভাষা, পত্র যোগাযোগ, গণমাধ্যমের ভাষা অবশ্যই বাংলা হতে হবে। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে বাংলায়। বাংলা ও বাঙালি একে অপরের পরিপূরক ও অবিচ্ছেদ্য। মাতৃভাষা মানুষের কাছে সবচেয়ে সুমধুর ও আপন।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা চর্চা নিয়ে অবহেলা লক্ষণীয়! এই আমরাই বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি করছি৷ আর ইংরেজির মতো করে বাংলা শব্দ উচ্চারণের প্রবণতা৷ এই প্রবণতা টেলিভিশন, এফএম রেডিও থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকট আকার ধারণ করছে- যা কোনোভাবেই সুস্থ বাংলা ভাষার চর্চা নয়৷
আমাদের দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের অধিকাংশের নাম বাংলায় নয় ইংরেজিতে৷ এসব নাম দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি না৷ প্রতিবেশী দেশ নেপালে আইন করে বলে দেওয়া আছে নেপালি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম থাকতে পারবে না৷ অন্যথা হলে সরকারের অনুমোদন পাবে না৷ দেশে পরীক্ষায় যে ছেলেমেয়েটি ইংরেজিতে ‘এ’ প্লাস পায়, সে নাকি বাংলায় ফেল করে। যদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দিকে তাকাই, চিত্র একই। বাংলা চলচ্চিত্রের নাম ইংরেজি। অনেক গানের কথায়ও একই অবস্থা। এটা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য বড়োই পরিতাপের বিষয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের নামটিও ইংরেজিতেই সমধিক পরিচিত। চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম বাতিল করার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ডের নামও পরিবর্তন করে বাংলায় করা উচিত। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এখন বিদেশের অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে, তাই ভাষাগত পরিবর্তনও দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ভাবতে হবে।
যখন দেখি টকশোতে বা সাক্ষাৎকারে শিক্ষিতজনেরা অর্ধেক ইংরেজি, অর্ধেক বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন। মনে হয় যেন তাদের মাতৃভাষাটা ইংরেজি, অনেক কষ্ট করে বাংলা বলছেন তারা।
বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আইন আছে৷ সংবিধানেও বলা হয়েছে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা৷ অথচ এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যায়নি৷ বিশ্লেষকরা এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন৷ সমস্যা পরিভাষার নয়, ইচ্ছাশক্তির। তবে নিজেদের মায়ের ভাষা তো অবশ্যই শিখবো এবং তার ব্যবহারও করব তবে নিজেদের বিশ্ব পরিমণ্ডলে আরও গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলতে ইংরেজি, আরবি, চীনা এবং হিন্দি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করবো তাতে তো কেউ বাধা দেবে না।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবাস জীবন ছেড়ে বাংলার টানে ফিরে আসেন। ইংরেজির বদলে বাংলায় সাহিত্য রচনা করেন। আমাদের দেশের ৭৩ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। যদিও তাদের ইংরেজি জ্ঞানের গভীরতার কথা আমার অজানা নেই। সাম্প্রতিক শুধু নয় সবসময় দেশের আদালতে মানুষের আনাগোনা বেশি। বিশেষ করে যারা কম শিক্ষিত তারা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে শুধুমাত্র ভাষার কারণে। অন্যদিকে পথে-প্রান্তরে ইংরেজিতে কী লেখা আছে তাও তারা জানতে পারছে না। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। নিজ দেশের ভাষাকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আরও শক্তিশালী করতে ও নিজেদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক ভাষা শিখব এবং বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেব।
মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম:কলামিস্ট, কবি ও আইন বিষয়ক গবেষক।
ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com