ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ঈর্ষণীয় সফলতা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। তবে ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে কিছু অভিযোগও রয়েছে। এগুলো দুই ধরনের। এক. ইসলামী ব্যাংকিং বিনিয়োগ পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে অভিযোগ। এগুলো ফক্বীহ ও ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সর্বসাধারণের মাঝে এসবের প্রভাব নেই বললেই চলে। দুই. প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে অভিযোগ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিম এবং জনসাধারণের ধারণা যে, ইসলামী ব্যাংকগুলোতে বাস্তবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যথার্থ প্রয়োগ নেই। তাদের বক্তব্য হলো ইসলামী ব্যাংকগুলোও সুদই নেয়। কনভেনশনাল ব্যাংকগুলো সরাসরি সুদ নেয় আর ইসলামী ব্যাংকগুলো ঘুরিয়ে সুদ নেয়।
তবে প্রকৃতপক্ষে দুই ধরনের অভিযোগের মধ্যেই কিছু বাড়াবাড়ি রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে শতোভাগ শরী‘আ পরিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না; এটা সত্য। কিন্তু তাই বলে ইসলামী ব্যাংকিংকে সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের সাথে তুলনা করা মোটেই সমীচীন নয়। ইসলামী ব্যাংকিংকে একটি আন্দোলন বলা যায়। এই আন্দোলনে মানুষের সম্পৃক্ততা যতো বৃদ্ধি পাবে ততোই এটি বেগবান হবে।
যাইহোক, ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে সকল অভিযোগ সঠিক না হলেও যৌক্তিক অভিযোগগুলোকে উড়িয়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাফল্যের পেছনে ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতিসমূহের সুবিধাদি ছাড়াও ইসলামপ্রিয় আমানতকারীদের আবেগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারা রিবা (সুদ) পরিত্যাগ করে মুনাফা লাভের আশায় ইসলামী ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রাখেন। সেই হিসেবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারক এবং ব্যাংকারগণ আমানতকারীদের নিকট দায়বদ্ধ।
ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যাসমূহ
প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে সমস্যা:
১. ইসলামী অর্থব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন, অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যাংকারের অভাব;
২. সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থাপনার কারণে পরকালীন জীবনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ ব্যাংকারের অন্তরে ভয় না থাকা;
৩. ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নে ব্যাংকারদের অবহেলা বা উদাসীনতা;
৪. মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকেই পারফরমেন্সের আসল মাপকাঠি হিসেবে মূল্যায়ন করার প্রবণতা;
৫. ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণাগার ও গবেষক তৈরির উদ্যোগ না নেয়া;
৬. মূলধারার আলেমদের সাথে ইসলামী ব্যাংকারদের দূরত্ব।
গ্রাহক পর্যায়ে সমস্যা:
১. ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সুফল এবং সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের কুফল সম্পর্কে জ্ঞানের অপ্রতুলতা;
২. সুদভিত্তিক লেনদেনের কারণে পরকালীন জীবনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে অন্তরে ভয় না থাকা;
৩. ভালোভাবে না জেনেই ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করার ব্যাপক প্রবণতা।
সমাধানের উপায়
ইসলামী ব্যাংকগুলোর করণীয়:
১. ইসলামী অর্থব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি নিয়োগ করা;
২. ইসলামী মনোভাবাপন্ন গ্রাহক বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোর প্রচেষ্টা চালানো;
৩. ইসলামী অর্থব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণার লক্ষ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পর্যাপ্ত গবেষণাগার ও গবেষক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৪. ইসলামী অর্থব্যবস্থাপনা সম্পর্কে লিখিত সহজপাঠ্য বই গ্রাহক ও শুভাকাঙ্ক্ষীসহ জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করা;
৫. মূলধারার আলেমদের সাথে ইসলামী ব্যাংকারদের দূরত্ব কমানো।
গ্রাহকদের করণীয়:
১. সুদের কারণে পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ভয় অন্তরে সর্বদা লালন করা;
২. বিনিয়োগ গ্রহণের পূর্বেই ইসলামী ব্যাংকিং বিনিয়োগ গ্রহণ পদ্ধতি ইসলামী ব্যাংকার অথবা বিজ্ঞ আলিমের কাছ থেকে ভালোভাবে জেনে নেয়া;
৩. ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কোনো বিষয়ে মনে সন্দেহের উদ্রেগ হলে যে কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করে সে বিষয়ে বিজ্ঞজনের কাছ থেকে বিষয়টি ভালোভাবে জানার চেষ্টা করা;
৪. ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে লেখা পত্রিকার কলাম, প্রবন্ধ ও বই পড়া;
৫. নিজে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরকেও এর সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাওয়া।
✍️ড. হাসান আলী (রুবেল)
ইসলামী চিন্তক, গবেষক, লেখক, আলোচক ও ব্যাংকার