সব
facebook apsnews24.com
করোনা অভিজ্ঞতাঃ ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা ও নিঃসঙ্গতা জয়ের গল্প - APSNews24.Com

করোনা অভিজ্ঞতাঃ ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা ও নিঃসঙ্গতা জয়ের গল্প

করোনা অভিজ্ঞতাঃ ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা ও নিঃসঙ্গতা জয়ের গল্প

অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন

জ্বর এলে না হয় থার্মোমিটারে মাপি, হৃদয়ের উষ্ণতা মাপবো কী দিয়ে? শরীরের কাটাদাগ দেখানো গেলেও, অন্তর কাটার দাগ কি দেখানো যায়? চিকিৎসাবিজ্ঞান কি আবিষ্কার করতে পেরেছে কলিজার অদৃশ্য ক্ষত সারানোর মলম? পারেনি নিশ্চয়ই। অথচ এইসব আজব রোগের অব্যর্থ সহজ চিকিৎসা হলো ভালোবাসার মানুষের কাছে আসা।
নয়ন ভরা চোঁখাচোঁখি, আলতো হাতের ছোঁয়াছুই-ই আর বিপদে নির্ভরতায় প্রিয় বুকে মুখ লুকানো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আদরে, দরদে জড়িয়ে ধরে গলাগলি করা, কিছু শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিচিত শব্দ, কিছু গায়ের গন্ধ, কিছু মুখের ঘ্রাণ পাওয়ার নেশা মাদকের চেয়ে কম নয়। কিন্তু এতে রোগ নিরাময় হয়।

২. করোনার শুরুর দিনগুলোতে আমার স্ত্রীর কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গায় আমার মা, স্ত্রী ও ছেলে অবস্থান করেছিল। এদিকে আমি ছিলাম আমার কর্মস্থল বরিশালে। প্রায় দুই মাস ধরে আমার চোখের মণি শান্ত হচ্ছিল না। প্রিয় সহধর্মিণীর সাথে দশ বছরের চেনাজানায় টানা এক সপ্তাহের বেশি না দেখে থাকিনি কখনো। হঠাৎ হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠতাম। ভিডিও কলে কথা বললে এক বছর বয়সী ছেলে আমাকে ধরতে যেয়েও পেত না। ও তখন মোবাইলের পিছনে আমাকে খুঁজে বেড়াতো। মা বলতো, ” বরিশাল থেকে চুয়াডাঙ্গা কতইবা দূর। ও চাইলে তো হেটেও আসতে পারে! ” হ্যাঁ, মা। আমি পারতাম। অনেক সুযোগ ছিল তোমাদের কাছে যাওয়ার। চাইলে যেতে পারতাম। কিন্তু সরকারি নির্দেশনা আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইচ্ছে করেই যাইনি। একজন ব্যাংকার হিসেবে বহুলোকের সংস্পর্শে আসা হয়। তাই বয়োবৃদ্ধ মা আর শিশুপুত্রের জন্যে মৃত্যুদূত হয়ে ফিরিনি তোমাদের কাছে। আমি আমার সুস্থতার ব্যপারে নিশ্চিত ছিলাম না। তাই ঝুঁকি বাড়াইনি। পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, দুই হালি হাসের ডিম আর একশো গ্রাম চা পাতা নিয়ে দরজায় খিল দিয়েছিলাম। জানতাম, জীবন আবার গতি পাবে। আবার কর্মব্যস্ত সূচিতে ফিরবে সব। মাঝখান থেকে কিছু সম্ভাবনাময় প্রিয়মুখ হারাতে হবে এই যা। মানুষ কখনো হারেনি মা। এবারও হারবে না তুমি দেখো। আমি তোমার পান চিবানো লাল ঠোঁটের মুগ্ধ ঘ্রাণের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি তা তুমি কিন্তু জানোনা, মা। পুত্র মিছিল আরিযের কচি চামড়ার তুলতুলে ছোঁয়া আর ফোকলা হাসির লোভেই তো প্রতি সপ্তাহে শত শত মাইল পারি দিতাম। এগুলো নেশা। মায়ার নেশা।

৩. সারাদিন করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর বৈশ্বিক আর দেশীয় সংখ্যাগণনা নিজের মনোবলে চিড় ধরায় দেখে এসব খবরে কম মনোযোগ দেই। যেহেতু আমি রোগতত্ত্ব বুঝিনা, তাই সংখ্যাতত্ত্ব ঘাটি না। করোনার ঔষুধ কেবল সচেতনতা, তাই এতে ছাড় দেই না। এই নিঃসঙ্গ সময়ে নিজেকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ নিচ্ছিলাম। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকনোমিস্ট পত্রিকার প্রচারণায় দেখেছিলাম ” Socially distanced. Intellectually engaged. ” আমি এতে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। নিজের সুকুমার বৃত্তির সমাদৃত উপকরণ “লেখালেখি” এর উপর জোর দিয়েছিলাম সেইসব দিনগুলোয়। নিজের প্রেয়সী প্রদত্ত শব্দ-কারিগর উপাধির সদ্ব্যবহার করতে নানা মিডিয়ায় কিছু ভালো খবরের ফেরিওয়ালা হয়েছিলাম। চারিদিকের দুঃসংবাদ আর হতাশার মিছিলে ক্লান্ত পাঠকদের জন্যে সাজিয়েছিলাম জীবনের জয়গানের শ্লোগানশোভিত কথামালা। আমাদের জরুরিসেবার নায়ক ডাক্তার, পুলিশ, প্রশাসন, সাংবাদিক, ব্যাংকার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দোকানদারসহ সবার কাজ ও অবদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখলাম ও বেসুরো কণ্ঠে গাইলাম, “ধন্যবাদ, তোমাদের ধন্যবাদ” গান। উদ্যোক্তা বন্ধুদের উৎসাহ দিয়ে সামাজিক দায় থেকে ডাক্তারদের জন্য তৈরি করালাম কিছু পিপিই। গাঁটের পয়সা খরচ করিনি। কারো কাছে যাইনি। কিন্তু যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণ আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ঘরে বসেই করোনার বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধে আমিও হয়েছিলাম একজন ক্ষুদ্র যোদ্ধা।

৪. আত্ম-জিজ্ঞাসায় অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াই। সব প্রশ্নের উত্তর হয়না, তবুও তালাশে মনকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই আজ কাজ। তবে অন্তত এই বোধটুকু জেগেছে যে, অন্যকে খারাপ রেখে নিজে ভালো থাকা যাবে না। অর্থবিত্তের লোভ সামলানো ইদানিং অনেকের জন্য সহজ হচ্ছে। পয়সায় জীবন পাওয়া যায়না। এমনকি চিকিৎসাও পাওয়া যায় না। করোনা তো তাই দেখাচ্ছে। তবে কেন মিছেমিছি অট্টালিকার লোভ? বেশিরভাগ মানুষই ভিতরে ভিতরে একেক জন নিঃসঙ্গ শেরপা। মানুষ হলো এক হাতে দুই লগি বৈঠা সামলে ভাসমান জীবন তরীর উজান বাওয়া একলা নাবিক। মনের অজান্তেই সে হয় কোনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। তাই কোলাহলের নিস্তব্ধতায় নিরবে সময় নিয়ে এসব ব্যাপারে আরেকটু ভাবার ফুসরত হলো বৈকি।

৫. পরিবার হলো মানুষের শাখের করাত। পরিবারের মায়ায় বহু বিপ্লবী রণে ভঙ্গ দেয়। পরিবারের মায়া কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। তাইতো সংসার প্রেমময়। কিন্তু হায়! এ যে বড় অসময়। অভাবনীয় এক ব্যামো এসেছে ধরায়। ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা আজ। আজকের দিনে ভালোবাসা মানে কাছে যাওয়া নয়! যতবেশি ভালোবাসা ততো বেশি দূরে থাকাই আজকাল নিয়ম হয়েছে। প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুরতার জবাবে আমাদের ভালোবাসার নিষ্ঠুরতম প্রকাশ হলো আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টিন প্রভৃতি। আমার মায়ের হাতের বেগুন ভাজা এবং বউয়ের রান্না করা খিচুড়ি হলো বিশ্বসেরা। কতদিন মুখে দেইনি সেই স্বাদ। মাঝেমধ্যে ভাবলে জিভে জল আসতো। পেটে মোচড় দিত। যেন ছুঁচোর মিটিমিটি! আমি এক অদ্ভূত মানুষ হিসেব অদ্ভূত কিছু শখ আছে আমার। এমনই একটি শখ হলো নানাপদে, নানা ঢংয়ে মানুষ দেখার শখ। মানুষের বাচ্চা পাক্কা এক বছর বয়সে কেমন হয় তা দেখার খুব শখ ছিল। লোকে খুব বয়স লুকায়। তাই সঠিক হিসেব পাওয়া দুষ্কর। তাই ঔরসজাত সন্তানের প্রথম জন্মদিনে এই আশা পূরণের মোক্ষম দিন ছিল। ঠিক এক বছর বয়স হলে মানুষের বাচ্চা কেমন হয় দেখতে, কয়টা দাঁত ওঠে? কীভাবে হাসে? ওদের কি কাতুকুতু আছে? হয়তো বেখেয়ালে অন্যের বাচ্চাকে দেখেছি। কিন্তু একেবারে নিজের, একান্ত নিজের; রক্তে, গায়ের রংয়ে, চেহারার মিলে থাকা শিশুটাকে দেখতে পেলে হয়তো নিজের শিশুকালের প্রতিবিম্ব দেখতে পেতাম। সাতই এপ্রিল দিনটি পার হয়ে গেলো। দেখতে পারলাম কই? করোনার কারণে জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। এই চাকরিটা পেলে স্বামী-স্ত্রী এক জায়গায় থাকার সুযোগ পাবো হয়তো। কিছুটা প্রস্তুতি না নিলে ভাইভা বোর্ডে যেয়ে দাড়াবো কোন মুখে? তাই টুকটাক পড়াশোনা করছিলাম সেই সময়।

৬. মানসিক চাপ সামলানো কঠিন, ভীষণ কঠিন। তাই সুন্দর কাজে নিজেকে জুড়ে রাখার চেষ্টায় আছি। তৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নেয়াই ভালো। তাই লেখালেখিতে ডুবে ছিলাম। অনেক দিন ধরে পড়ে থাকা অসমাপ্ত উপন্যাসটির ধুলোমাখা পান্ডুলিপি ঝেড়ে তাতে থরে থরে আরো কিছু শব্দযোগ করে যাচ্ছিলাম। জানিনা হাতের কাজ সব শেষ করার সুযোগ পাবো কিনা। মানুষের পরম শক্তি হলো আশা। তাই আশা বেঁচে থাকুক। স্বপ্নগুলো লালিত হোক মনের কোঠরে। মানুষ ভালো থাকুক। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে গোলা-বারুদের চেয়ে মানুষের মূল্য বাড়বে, অন্তত এই আশা তো করি। দুর্যোগের মেঘ কেটে আলো আসবেই। তাই ধৈর্য ধারণ করি।

ভালোবাসার পুরনো খাঁদগুলো ঝালিয়ে মেরামত করার এখনই সময়। খুব ভালোবাসি বলেই দূরে থাকি আরো ভালোবাসার আশায়। ভালোবাসা বাচিঁয়ে রাখতে সাধ্যে কুলোলে ঘরে থাকুন। প্রয়োজনে একা থাকুন। আত্মবিকাশে মনোযোগী হলে নিজের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকবে। ভুলে গেলে হবে না; আজকাল যতবেশি ভালোবাসা ততোই বেশি দূরে থাকা সবার জন্যেই শ্রেয়। দূরে বসেই ভালো থাকুক প্রিয়জনেরা।
ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখকঃ আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।
তিনি ” আমাদের স্বপ্ন ” সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক। প্রতিক্রিয়া জানাতে ইমেইল করুন এই ঠিকানায় bellal.sincere@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj