বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। চিনের উহান প্রদেশ থেকে ভাইরাসটির বিস্তার শুরু হলেও বর্তমান এটি দুইশ তেরোটি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।বাংলাদেশেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যুও।চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, করোনা ভাইরাসের মূল আক্রমণ স্থল ফুসফুস। এ ভাইরাস নাক বা মুখের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে এবং ধীরে ধীরে এর কার্যক্ষমতা নষ্ট করে রোগিকে জটিল রোগে ভুগিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। ঠিক এই পরিস্থিতিতে আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্রের নাম ভেন্টিলেটর। ভেন্টিলেটর হলো লাইফ সেভিং ডিভাইস যাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রও বলা হয়ে থাকে। রোগের জটিলতা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায় তখন রুগী এতোই অসুস্থ হয়ে যায় যে নিজ থেকে আর শ্বাস- প্রশ্বাস চালু রাখার কাজটি করতে পারে না। ঠিক তখনই ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৮০-৮২ ভাগ সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে আর বাকী ১৮-২০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা নিতে হয় হাসপাতালে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ রোগীর জন্য প্রয়োজন হতে পারে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস সুবিধা বা ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সাপোর্ট। আর ৫ শতাংশের জন্য লাগতে পারে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট অর্থাৎ নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সুবিধা।
দেশে যেভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনে প্রচুর সংখ্যক ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারি ও বেসরকারি সব মিলিয়ে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা মাত্র ছয়শ’র কাছাকাছি । আবার যে কয়টা ভেন্টিলেটর আছে তার মধ্যে কিছু আছে ব্যবহারের অনুপযোগি।
এ ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে আক্রমণ করলে রোগী ঠিক ভাবে শ্বাস নিতে পারে না। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে কিন্তু বাড়তে থাকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা। এভাবে চলতে থাকলে রোগীর মস্তিষ্ক, হৃদপিন্ডসহ বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ অচল হয়ে যেতে শুরু করে ঠিক এই পরিস্থিতিতে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে রোগীর শরীরে কৃত্রিম ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করে কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে আনে। যার ফলে অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়ে ওঠে।চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিডনি রোগের ক্ষেত্রে যেমন ডায়ালাইসিস এক প্রকার লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম, হৃদযন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন প্রেস-মেকার, ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন কেমোথেরাপি ঠিক তেমনি করোনা আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুসের সংক্রমণ ঠেকাতে লাইফ সাপোর্টিং সিস্টেম হলো ভেন্টিলেটর। একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে ১০-১২ দিন ভেন্টিলেশন রাখা লাগতে পারে।উন্নত দেশে এতো লোক মারা যাওয়ার কারণ হলো ভেন্টিলেটর স্বল্পতা। ইতালি আর আমেরিকায় ভেন্টিলেটরের অভাবে অনেক রোগী চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মারা গিয়েছে। ইতালির হাসপাতালগুলো হঠাৎ করে এতো রোগী সামাল দেয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সেই সাথে তাদের ছিল না পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর। ঠিক আমেরিকাতেও এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই। প্রবাসী যে সকল বাংলাদেশি মারা গিয়েছিল তাদের অনেকেই ভেন্টিলেটর সুবিধা পাননি।করোনা আক্রান্তর দিক থেকে বর্তমান শীর্ষ দুই দেশ আমেরিকা ও ব্রাজিল। ব্রাজিলের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই সাথে ভেন্টিলেটর ও আই সি ইউ( নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র)পর্যাপ্ত না থাকার কারনে অনেক রোগী চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে।বিশ্বের কোন দেশই হঠাৎ করে এতো রোগী সামাল দেয়ার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না যার ফলে অনেকটা বিপর্যয় নেমে আসছে।
গত কয়েক মাসের করোনা পরিস্থিতিতে ভেন্টিলেটরের চাহিদা বেড়েছে ১৫ শ গুণেরও বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভেন্টিলেটর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হলো মেডট্রোনিক যারা স্বপ্নেও ভাবেনি ভেন্টিলেটরের চাহিদা এতো বেড়ে যাবে। মেডট্রোনিকসহ ভেন্টিলেটর উৎপাদনকারী বিশ্বের যতগুলো নামী দামী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবগুলো প্রতিষ্ঠান যদি টানা ২৪ ঘন্টাও তাদের উৎপাদন চালু রাখে তবুও ভেন্টিলেটরের যে চাহিদা বাজারে তৈরি হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব না।
তবে আশার কথা হলো,মেডট্রোনিক এর সহায়তায় বাংলাদেশেই ভেন্টিলেটর তৈরি করতে শুরু করেছে দেশীয় কোম্পানি ওয়ালটন।(সূত্র : দ্যা ডেইলি স্টার-১৫ই এপ্রিল ২০২০)
দেশের করোনা পরিস্থিতি যখন ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে ভেন্টিলেটর যন্ত্রের মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। আর এর জন্য দরকার পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর পাওয়া সম্ভব না তাই যত সংখ্যক ভেন্টিলেটর আছে তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সেই সাথে সরকারের উচিত হবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ভেন্টিলেটর এবং ভেন্টিলেটর সংশ্লিষ্ট উপকরণ আমাদানীতে সর্বাধিক গুরত্ব দেয়া।বৈশিক করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিষেধকের খবর পাওয়া যায়নি। তাই এই মুহূর্তে আমাদের প্রতিরোধ করাই হবে একমাত্র কাজ। আর এই মহামানী বিপর্যয়ে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ভেন্টিলেটর।
লেখক:মীর শুভ
শিক্ষার্থী :আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।