আল আমিন ইসলাম নাসিম
রাজনীতি হল কোন সমাজের জন্য মূল্যবান বিষয়গুলোর কর্তৃত্বপূর্ণ সুষম বন্টন । অপরদিকে রাজনীতি হল অর্থনীতির সবচেয়ে ঘণীভূত বহিঃপ্রকাশ । সুতরাং বোঝাই যায়, অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অপরের সম্পূরক । সুদীর্ঘ সময় ধরে দেখা গিয়েছে অর্থনীতি রাজনীতিকে শাসন করছে আবার রাজনীতিও অর্থনীতিকে শাসন বা নিয়ন্ত্রাধীন করে রেখেছে । কেননা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় উপকরণ, বস্ত্র, খাদ্য, চিকিৎসায়, শিক্ষা প্রায় সর্বত্রই অর্থ নীতিনির্ধারক হিসেবে কাজ করে । আবার এই নীতিনির্ধারক হিসেবে রাজনীতিই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কাজ করতে দেখা যায় । কিন্তু নীতিনির্ধারকই যখন ভক্ষক ও রক্ষক হিসেবে কাজ করে তখনই যেন যত্রতত্র অব্যবস্থনা ও দুর্নীতির অভিষেক ঘটে । দেখা যায় নীতিনির্ধারক নিজেই অঢেল সম্পদের আত্নসাৎ ও পাহাড় গড়তে ব্যস্ত । বর্তমান কভিড-১৯ এর সময়ে নীতিনির্ধারকদের সম্পদের পাহাড় গড়ার তেমনই চিত্র যেন পরিলক্ষিত হচ্ছে ।
কভিড-১৯ সংক্রমণে দিন দিন বেড়েই চলেছে । যার ফলশ্রুতিতে লাখো মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, মিল-কারখানা বন্ধ, গার্মেন্টস্ প্রতিষ্ঠান বন্ধ, দ্রুত পচনশীল পণ্য সরবরাহ বন্ধ, স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত ব্যায়, কর্মহীনদের বেতন প্রদানের মতো ইত্যাদি কারনে ধ্বস নেমেছে অর্থনীতিতে । কাজেই অর্থনৈতিক এ ধ্বসের ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনও ব্যাপক নড়চড়ে গিয়েছে । শুধু দেশীয় রাজনীতির অঙ্গনে নয় বরং বৈশ্বিকভাবেও রাজনীতির অঙ্গনে ব্যাপক ভাঙ্গন ধরেছে । আর এই ভাঙ্গনের ফলেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ কেমন হবে তা রাজনীতি মনন ব্যাক্তিদের নিকট চরম ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ! অর্থনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অতি মনোনিবেশের ফলে রাজনীতি অঙ্গনের দিকে পর্যবেক্ষণ করতে যেন অনেকেই ভুলেই গিয়েছেন । অর্থনৈতিক দূরবস্থার ফলে রাজনীতির অঙ্গন আজ এতো উত্তেযিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত ।
বাংলাদেশের রাজনীতির এখন যেন মৎস্যন্যায় অবস্থা । নানা ধোঁয়াসায় জর্জরিত । এমতাবস্থায় স্বাস্থ্যখাত, বাঁধের অব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে বাঁক স্বাধীনতা হরণ, নাম মাত্র গনতন্ত্র, ক্যাম্পাসে ভাইতন্ত্রবাদ, গ্রামে ওস্তাদতন্ত্রবাদ রাজনীতি, সকল রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তরুণদের রাজনীতি প্রাঙ্গণে নিরপেক্ষতা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের তৈরি না হওয়া , স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব, ইত্যাদি যেন তার জ্যন্ত উদাহরণ । দেশে স্বাস্থ্য খাতে এমন অব্যবস্থনা ও দুর্নীতি সত্যিই জোরালো ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষের । এখনও যেখানে খাতাকলমে ডাক্তারের পূর্ন ভাবে থাকার কথা রয়েছে কিন্তু বাস্তবে তা নেই । এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও ব্রোকার বিদ্যমান, যারা হাসপাতালের প্রায় ঠিকাদারি বা দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে । অনেক স্থানে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও অপ্রতুল । অনেক স্থানে আবার টেকনোলজিস্ট এর কমতি ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন এবার স্বাস্থ্য খাতে বড়ো বরাদ্দ দিবেন, কিন্তু তা পর্যাপ্ত দেননি বলে তারা মনে করছেন । আবার অনেকে বলছেন স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দের আশা করেছিল, বাস্তবে তা অনেকাংশে কম । করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে অনেকে বিড়ম্বনায় পড়েছে, অনেকের আবার ভূয়া রিপোর্ট তৈরির অভিযোগ , আবার বেসরকারি হাসপাতালের লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ শোনা যায় । পাশাপাশি বিনামূল্যের যে চিকিৎসা সেবা বা বিনামূল্যে করোনা পরিক্ষার কথা ছিলো তাও এখন নেই । এছাড়া অনেক ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছেন না । বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর পরই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরবরাহ করা মাস্ক, পিপিই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে । এছাড়া কয়েক মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে আসে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ (ডব্লিউএইচও) অনুসারে, যেকোনো দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া অত্যাবশ্যক । কিন্তু ডব্লিউএইচও-এর মতানুযায়ী বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সব মিলিয়ে জিডিপির ৩ শতাংশ খরচ করা হয় । যেখানে সরকারের অবদান থাকে মাত্র ১.০২ শতাংশ । ৬.৩৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন চিকিৎসা সেবার জন্য । প্রতি এক হাজার ৫৮১ জন মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছেন একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক । প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় চিকিৎসকের সংখ্যা ১.২৮ জন ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি দেশে প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনোলজিস্ট থাকা আবশ্যক । কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্তমানে বাংলাদেশে তা পর্যাপ্ত নেই । মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে দুর্নীতি করে নিয়োগ দেয়ার খবর কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে । বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে । দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি বলেছে, এখন সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা অনুসরণ না করে স্বাস্থ্যখাতের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে কেনাকাটা করা হচ্ছে এবং তাতে অনেক জিনিস বাজার মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দামে কেনার মতো অনিয়ম হচ্ছে । সংস্থাটি আরও বলেছে, মহামারির সময় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বাস্থ্যখাতের এক শ্রেনীর কর্মকর্তার সহায়তায় কেনাকাটায় অনিয়ম দুর্নীতি করার চিত্র তাদের গবেষণায় ফুটে উঠেছে ।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর পরই গত মার্চ মাসে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষাধাগার থেকে সরবরাহ করা এন৯৫ মাস্ক এবং পিপিইসহ স্বাস্থ্য কর্মিদের সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল । স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্নীতি, তা কভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে কতটা দুর্নীতি হয় । কেনাকাটার ক্ষেত্রেই দুর্নীতিটা বেশি হচ্ছে । মেডিসিন যেসব সরকারিভাবে কেনা হচ্ছে, সেগুলো ভাল কোম্পানি থেকে নেয়া হচ্ছে না । এমন সব কোম্পানি থেকে এমন সব ঔষধ নেয়া হচ্ছে, যেগুলো ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনেও লেখে না । এখনও আইসিইউ , অক্সিজেনের অভাব আছে । মাঝে কিট সংকটের কথাও শোনা যায় । সম্প্রতি ইতালির ঘটনা যেন উল্লেখযোগ্য যে বিষয়ে প্রায় সকলেই জ্ঞাত । আবার কেনাকাটায় নিম্নমানের জিনিসের উচ্চ দাম পর্যন্ত দেখাচ্ছে । এছাড়া কিছুদিন আগে হাতাপাতালে ডাক্তারদের খাবারের যে পরিমাণ মূল্য তালিকা দেখানো হয়েছিল তা ছিল আকাশচুম্বী ।
স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের । গত বছরের শেষে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্দা কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল । মোট বাজেটে শতকরা হিসেবে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ২ (৫.২%) ভাগ । অন্যদিকে তার চেয়েও বেশি বরাদ্দ আছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, জনপ্রশাসনে, সুদ পরিশোধ, স্থানীয় সরকার, পরিবহন ও যোগাযোগে । বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতে এতদিন কতটা কম মনোযোগ দেয়া হয়েছে এবং কত বড় ধরনের সংস্কার এক্ষেত্রে দরকার । জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তেমন কোন চমক রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না । তিনি বলছেন, যেটা হয়েছে সেটা ক্ষতে মলম লাগানোর মতো । এখন একটা ঘা তৈরি হয়েছে, মলম লাগিয়ে ভাল করলাম । স্বাস্থ্য খাতের খরচের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একদিকে বাজেটে যেমন বরাদ্দ কম, অন্যদিকে এই বরাদ্দের যতটা না চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় ভৌত অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও বেতন-ভাতার পেছনে । চলতি বছরের মোট বরাদ্দ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা চলে গেছে পরিচালন খাতে । এর মাত্র এক চতুর্থাংশের মতো বরাদ্দ হচ্ছে ঔষুধ ও সরঞ্জাম কেনার পেছনে । বাকি অর্থ চলে যাচ্ছে বেতন-ভাতায়, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এখনো চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা অনেক কম ।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলছেন, ”সক্ষমতার অভাব, কিছুটা দুবৃর্ত্তায়ন আছে, একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে যারা এগুলো অপচয় করে -সবকিছু মিলে আমূল সংস্কার দরকার । সংস্কার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ছাড়া বরাদ্দ বাড়ালেও স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন আসবে না।” তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের সব কেনাকাটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে করা হচ্ছে । সব মিলিয়ে বর্তমান সরকারের উচিৎ ছিলো এগুলো পূর্ব থেকেই গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষন করা । সুশীল সমাজরা আবার বলছেন, শুধু বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই এমন চিত্র নয়, পূর্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন দুর্নীতি পরায়ণ চিত্র গুলো দেখা গিয়েছে । যার বলির পাঁঠা হয়েছে সর্বদাই জনগণ । আবার সাধারণ জনগণের মধ্যে শোনা যায়, সরকার দলীয়র মধ্যে সমঝোতা ও কঠোর ব্যবস্থার না নেওয়ার ফল এটি । তাই অনেকেই মত দিচ্ছেন আগামী সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গন গুলো ঢেলে সাজাতে হবে তবেই এসব দুর্নীতি দমন হবে । রাজনীতি শুধু ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় নির্মগ্ন না থেকে জনগণের কল্যাণ সাধন এর দিকে নজর দিতে বলছে সাধারণ জনগণ ।
কেননা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা থাকলেই এসব অরাজকতা থেকে বের হওয়া যাবে এবং স্বস্তির মুখ দেখতে পাবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ । সত্যিই প্রতিদিনের এমন অরাজকতার ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে । পত্র-পত্রিকায় কিংবা সরাসরি টেলিভিশনে এমন প্রত্যক্ষ খবর লোমহর্ষক এর ন্যায় । এছাড়া সরকারের স্বাস্থ্যখাত ব্যতিত যদি অন্য প্রসঙ্গে যায় যেমন : নদী বাঁধ প্রায়স্থানে আছে কিংবা নেই কিন্তু মজবুত বাঁধের ব্যবস্থা নেই, আর যারা নদী খননের কাজ করেছে, স্বয়ং আল্লাই জানে তারা কি করেছে ? এইতো সেদিন দেখলাম পত্রিকার ফন্ট পেজে একটা বাঁধ এলাকার তরুণ ছেলে বুকে লিখে রেখেছে ( ‘ ত্রাণ চাই না , মজবুত বাঁধ চাই ‘ ) । সত্যিই এগুলো মনকে হালকা করে রাখার মতো ঘটনা নয় । বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করবো না, তিনি এবছর সর্বোচ্চ অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, ভালো মানের বাজেট দিয়েছে কিন্তু এখনও এতো উন্নয়নের ভিড়ে যে, সুষ্ঠু পূর্ব পরিকল্পনার অভাব কিংবা যে দুর্নীতির চিত্র আমাদের সবার সামনে এই মহামারি কিংবা বন্যার মতো দুর্যোগে উঠে এসেছে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে এরকম করুন পরিস্থিতি সত্যিই গাঁয়ে কাটা দেয় ।
এছাড়া সরকারের ‘ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘ অধীন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ অনেক জনকে বহিষ্কার কিংবা জেল জরিমানার মতো ঘটনা পরিলক্ষিত হয়, শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা স্টেটাসের কারণে । মানুষ এখন সমালোচনা করতেও যেন ভয় পাই । বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে এখন অনেক পিতা মাতাই তাদের সন্তানকে বলে থাকেন ‘ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু না লিখতে, যদি কিছু হয়ে যায় ‘ । বাঁক স্বাধীনতা যেন হরণ করা হয়েছে, যা সত্যিই অগনতন্ত্রিক । গনতন্ত্র বলতে আমরা কি বুঝি ? গণতন্ত্র হল ‘জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার’ কিন্তু বর্তমান প্রক্ষাপটে এ সঃজ্ঞা পুরোপুরিই উল্টো । এখনও যেন গনতন্ত্রের চোরাবালিতে দেশের মানুষ নিমজ্জিত, যেখানে একজন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতেই ভয় পাই । বর্তমান এই পরিস্থিতি থেকে কবে আমরা উত্তরিত হতে পারবো তা এখন গোলক ধাঁধার ন্যায় । তবে সরকার বা বিরোধী যে দলেরই হোক না কেন সকলের মনে রাখা উচিত ‘ সমালোচনা গনতন্ত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে থাকে ‘ ।
শুধু বর্তমান সরকার নয় , বরং বিরোধী বা বিগত দলগুলো যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতাই ছিলেন , জনগণের কল্যাণ অপেক্ষা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে নির্মগ্ন ছিলেন । রাজনৈতিক অঙ্গনে তখনও যেমন অস্থিরতা দেখা দিতো, এখনও যেন পরিস্থিতি অনেকাংশে তেমনই দেখা দেয় । বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল দুটি ১.বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও ২.বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল । কিন্তু যখনই যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন সর্বক্ষন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করতেই যেন ব্যাস্ত, সর্বক্ষন অস্থিরতা । আর যার ফল বর্তমান তরুণদের রাজনীতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও হেন মনোভাব । অর্ধেকের বেশি তরুণই রাজনৈতিক অঙ্গনে নিরপেক্ষ থাকে বা রাজনীতি পছন্দ করে না । কেননা রাজনীতি নিয়ে এখনও তাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে । বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছেলে মেয়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেই যেন পিতা-মাতার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে । রাজনীতির এ বেহাল দশা হবে কেন ? যেখানে আমরা ‘৫২, ‘৭১ এর কথা শুনি ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র রাজনীতি ছিল বড়ো একটা অংশ, দেশকে স্বাধীন করার সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব তাদের ছিল । এখনও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি পৃষ্ঠপোষকতা সঙ্গে নিয়ে খুন, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, টেন্ডার বাজি, ইভটিজিং ইত্যাদির মতো ঘটনা পরিলক্ষিত হয় ।
তাহলে বুঝুন রাজনীতির কোন প্রাঙ্গনে আমরা অবস্থান করছি । যেখানে ছাত্র রাজনীতি সবচেয়ে বড়ো কান্ডারি ছিলো দেশকে স্বাধীন বা বিভিন্ন আন্দোলনে কিংবা দেশের উন্নয়নে, আর আজ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ ছাত্রই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে ভীতি প্রদর্শন করতে বা নিরপেক্ষ হতে দেখা যায় । এছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের দলটি বেছে নিয়ে থাকেন, কিন্তু গত দুই এক নির্বাচনে বর্তমান বড়ো বিরোধী দলের নাকচ দেখা যায় । এদিকে বর্তমান সরকারের কিছু নেতার কথা শোনা যায়, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করিলে না করুক , আবার বিএনপির ও কিছু নেতার কথা শোনা যায় ইসি সম্পর্কে বা আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে । কিন্তু এখানে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও যেমন ক্ষতি, তেমনি আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও তেমন ক্ষতি । কেননা বার বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ বর্তমান সরকার দলের মান সত্যিই ক্ষুন্ন করে ।
যাহোক বর্তমান রাজনীতির বা পূর্বের রাজনীতি যাই বলি, একটা অস্থিরতা সব সময়েই দেখা গেয়েছে । বিএনপির নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে বলতে দেখা যায় আবার সরকার দলীয় নেতার বিরোধী দল সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য শোনা যায় । একে অন্যের দলকে সর্বদা মহান প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত । এ যেন বেজি আর সর্পের ন্যায় সম্পর্ক । বর্তমান রাজনীতি প্রেক্ষাপটে যেরকম রাজনীতি দেখা দেয় তাহলো ভাইতন্ত্রবাদ । এই ভাইতন্ত্রবাদ রাজনীতির ফলেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেক সাধারণ মানুষেরসহ অনেক তরুণদের । এই ভাইতন্ত্রবাদ রাজনীতির মুক্তি না ঘটাতে পারলে সাধারণ মানুষেরা সবসময় আতঙ্কেই থাকবে । এছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার অপব্যবহার যেন প্রায়ই দেখা যায় , ছোট বড়ো অনেক গ্রাম্য রাজনৈতিক দল যেন এটি আরও বেশি করে থাকে । ক্ষমতার জোর পূর্বক অপব্যবহার সব সরকারের সময়েই কম বেশি দেখা গিয়েছে । বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয়ের দেখা মেলে তাহলো ওস্তাদতন্ত্র । ওস্তাদ রাজনীতি করছে, রাজনীতির অপব্যবহার করে খারাপ কাজ করছে, কিন্তু কর্মী তার পক্ষে সাঁই দিচ্ছে । মানে বিষয়টি হলো এমন, ‘ওস্তাদ ইজ অলওয়েজ রাইট’ রাজনীতি ।
রাজনীতির অঙ্গনে ভবিষ্যতে রয়েছে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ । তা হলো নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করা ও সকল দলের অংশগ্রহণ । লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে । যেখানে লেভেল প্লেয়িং আছে সেখানে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে । এতে প্রচারণায় বাঁধা বা হয়রানির শিকার হতে হয় না, স্বচ্ছতা থাকে রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে । তাই ভবিষ্যৎ রাজনীতি চ্যালেঞ্জে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাছাড়া সকল দল অংশগ্রহণ করলে, রাজনীতির পরিবেশও সুন্দর হয়ে ওঠে । প্রতিবারের ন্যায় স্বল্পসংখ্যক ভোটে নির্বাচন হওয়া, ভোটারের ভোট না দিতে পারা এসকল বিষয় সত্যিই রাজনীতিকে দুর্বিষহ করে তুলেছে । এ থেকে বিরত থাকতে হবে । সাধারণ জনগণ গনতন্ত্রে বিশ্বাসী । যেখানে মানুষের বাঁক স্বাধীনতা থাকবে, মানুষ স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে । রাজনীতি সম্পর্কে আর কেউ হেন মন্তব্য করবে না । তরুণ মেধাবী ছাত্ররা দেশের উন্নয়ন সাধনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে নিজে রাজনীতি অঙ্গনে আসবে । এছাড়া ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ।
সবসময় এক দল অন্য দলকে দোষারোপ না করে, করোনার মতো এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সমন্বয় আনতে হবে রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে এবং সেই সাথে সকল দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ জনসাধারণের জন্য একত্রে কাজ করতে হবে । বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে সবসময়ই রাজনীতির মাঠ অস্থির হয়ে থাকে, যার ফলে বৈদেশিকদের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্পর্কও গড়ে তোলা প্রায়শই কষ্টকর হয়ে যায় । যা বাংলাদেশের জনগণের নিকট একান্তই কাম্য নয় । কেননা বাংলাদেশের মানুষ চাই, স্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা রাজনীতি পরিবেশ । যার মাধ্যমে দেশ ও দশ এগিয়ে যাবে, উন্নয়ন সাধিত হবে । পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতির পরিবেশ সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে । যেখানে তাদের মেধা , শ্রম দিয়ে রাজনীতির অঙ্গন সমৃদ্ধ করবে । রাজনীতি বিকাশের বা রাজনীতি সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়ন সমৃদ্ধি হয়ে থাকে ।
এছাড়া রাজনীতির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ এর মধ্যে অন্যতম একটা চ্যালেঞ্জ হলো ‘ছাড়’ । সবসময় হানাহানি, গুম, কাটাকাটি, মারামারি রাজনীতি থেকে বিরত থেকে ছাড়ের মাধ্যেমে রাজনীতি করাই শ্রেয় । এর ফলে রাজনীতির ভাবমূর্তি রক্ষা পায় এবং সুশীল সমাজসহ সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । এছাড়া ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি রয়েছে তাহলো জনকল্যাণ সাধন , মানবিকতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা । রাজনীতি সবসময় জোর পূর্বক ঘটনা ঘটাবে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করবে এমনটি নয় । দলবল নির্বিশেষে সকলের পরিকল্পনা হবে, ‘ জনকল্যাণ সাধন করা , জনগণের কথা চিন্তা করা, ক্ষমতায় মগ্ন না হয়ে জনগণের সুযোগ সুবিধা গুলো নিশ্চিত করা এবং গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ‘। এমন রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেখানে সকলের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, পাশাপাশি ক্ষমতাবান রাজনীতি দলের উচিত হবে তাঁদের কর্মকাণ্ডের পূর্নাঙ্গ স্বচ্ছতা প্রদান ও জবাবদিহিতা করা । তবেই সুসাশন প্রতিষ্ঠা হবে এবং প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে । পরিশেষে রাজনীতি দলের মধ্যে সমঝোতা করে কাজ করতে হবে । ভবিষ্যতে অনেক বাঁধা বিপত্তি আসতে পারে যেমন জলবায়ু পরিবর্তন বা দুর্যোগ ।
এসকল কর্মকাণ্ডে সকল রাজনীতি দলের সরাসরি অংশগ্রহন করে সাধারণ মানুষের সাহায্য এগিয়ে আসতে হবে এবং সমন্বিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে । এছাড়া বর্তমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সকলের নির্বিশেষে কাজ করতে হবে । প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে , জনগণের প্রতি মানবিক হতে হবে, একত্রে তাদের ত্রাণ সাহায্য করতে হবে । এছাড়া রাজনীতির সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি । সুতরাং রাজনীতির মাঠে যে দলই আসুক, সকলের রাজনীতি আর্দশের একটাই মূলমন্ত্র হওয়া উচিত তাহলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা । কেননা দুর্নীতি একটি দেশ ও জাতির উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় । রাজনীতি দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করে থাকে ।
সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতির যে করুন প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ তা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো রাজনীতির সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা এবং তরুণদের রাজনীতি প্রাঙ্গণে উজ্জীবিত করা । বাংলাদেশের মানুষ এমন হাহাকারের রাজনীতি চাই না, তারা চাই ‘৭১ এর সমঝোতার রাজনীতি, সুন্দর রাজনীতি, গনতন্ত্রের রাজনীতি, সর্বদলীয় নির্বাচনের রাজনীতি, তরুণদের প্রত্যাশার রাজনীতি যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে জনকল্যাণ সাধন ! তবেই হয়তো দেশের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে । যাইহোক সর্বশেষ একটা কাল্পনিক দৃশ্যর কথা শেয়ার করতে চাই, যেটি সর্বদা আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক করে । ট্রাম্পের দেশের একজন লোক, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি প্লাকার্ডে লিখে হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আর এদিকে ট্রাম্প যাওয়ার পথে একটা মুচকি হাসি দিয়ে, লোকটিকে ‘গুড লাক’ বলে চলে যায় । আর এ দেশে…
আল আমিন ইসলাম নাসিম
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
মোবা নং : ০১৭৯৩৩৩০১৪৫
ইমেইল : alaminislamnasim@gmail.com