মুজাহিদুল ইসলাম
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় অনেক আইন বিশেষজ্ঞ দেশে জরুরী অবস্থা জারীর পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু জরুরী অবস্থা জারী না করে বিদ্যমান আইনেই করোনা ভাইরাস মোকবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮এর ৪ নং ধারায় সংক্রামক রোগের তালিকা দেয়া রয়েছে এবং ৪(ভ) ধারা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন দ্বারা সরকার নতুন কোন রোগ কে সংক্রামক হিসেবে ঘোষণা করতে পারে।
জরুরী অবস্থা জারী করতে হলে তিনটি বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সন্তুষ্ট হতে হবে (১) যুদ্ধ, (২) বহিরাক্রমণ ও (৩) অভ্যন্তরীণ গোলযোগ (internal disturbance)। প্রথম দুটি কোন ভাবেই প্রযোজ্য না আর করোনার কারনে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ (internal disturbance) দেশে তৈরী হয়েছে বলে মনে হয় না। করোনার কারনে ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চলাফেরা বা সমাবেশের স্বাধীনতা খর্ব করার কথা অনেকে বুঝাতে চাচ্ছেন যাতে জনগণের মধ্যে করোনার সংক্রমণ না হয়। তো সেটা জরুরী অবস্থা জারী না করেসংবিধান ও সংক্রামকরোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী সম্ভব।
অনুচ্ছে ৩৬ ও ৩৭ অনুযায়ীজনস্বার্থে/জনশৃঙ্খলা/জনস্বার্থের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (subject to any reasonable restrictions imposed by law) জনগণের চলাফেরা ও সমাবেশের স্বাধীনতা থাকবে। জনস্বার্থে ও জনস্বার্থের স্বার্থে সরকার যদি সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ১৬(গ)ধারারবাধা-নিষেধ অনুযায়ী কোন স্থানে জন সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ বা সীমিত করণ করে বা ১৪৪ ধারার বাধা-নিষেধ অনুযায়ী জনবিচ্ছিন্ন করা হয় তাহলে করোনা নির্মূলের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়। সুতরাংজরুরী অবস্থা জারী করে অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব কোন দরকার নেই।
তাছাড়া বিশিষ্ট সংবিধিান বিশেষজ্ঞ প্রয়াত সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম স্যারের লেখা অনুযায়ী- “In case of proclamation of emergency for internal disturbance, there must be actual disturbance which threatens the security or economic life of Bangladesh.” সুতরাং উল্লেখিত দুটি শর্তের একটিও এখনপর্যন্তদেশে বিদ্যমান নেই।যে কারনে এখনই দেশে জরুরী অবস্থা করা হবে অসাংবিধানিক।
পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ (internal disturbance)এর কারনে জরুরী অবস্থার জারীর সুযোগ ছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জরুরী অবস্থা জারী করে জনগণের উপর অনেক বেআইনী সুবিধা গ্রহণ করায় ভারতেরপার্লামেন্ট৩৫২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে internal disturbance এরসাথে ‘by armed rebellion’ যুক্ত করেছে। সুতরাং ভারতে এখন রাস্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ নাহলে জরুরী অবস্থা জারীর সুযোগ নেই। সুতরাং জরুরী অবস্থায় অপব্যবহারের শঙ্কাই বেশি।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মিডিয়ায় করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণের জন্য’আইসোলেশন’, ’কোয়ারেন্টাইন’ ও ‘লক্ডডাউন’ শব্দগুলি খুব ব্যবহৃত হচ্ছে। জরুরী অবস্থা জারী করে জনগণের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে এই আইন অনুযায়ী ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
’লকডাউন’-
উক্ত আইনের ১১(২) ধারায় বলা হয়েছে“(২) মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, যথাযথভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়া তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সংক্রামক রোগ সীমিত বা নির্মূল করা সম্ভব নহে, তাহা হইলে তিনি সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে বা সংক্রমিতস্থানে অন্য কোনো ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ, সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন“ সুতরাং এই ধারা অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মচারী কোন এলাকা লকডাউন ঘোষণা করতে পারেন। ১৬(ক) ধারা অনুযায়ী সন্দেহজনক স্থান জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট স্থানে জনসাধারণের প্রবেশ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিতকরণও করা যায়।
’কোয়ারেন্টাইন’ ও ’আইসোলেশন’-
ধারা-১৪ অনুযায়ী সংক্রমিত ব্যক্তিকে আইসোলেশন ও করার সুযোগ রয়েছে। এখানে বলা হয়েছে- “যদি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর এইরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে, কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা না হইলে তাহার মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত হইতে পারেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তিকে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, সাময়িকভাবে অন্য কোনো স্থানে স্থানান্তর বা জন বিচ্ছিন্ন করা যাইবে।”
যানবাহন জীবাণুমুক্ত করণ:
উক্ত আইনের ১৮ ও ১৯ ধারা অনুযায়ী কোন যানবাহনে সংক্রামক জীবাণূর উপস্থিতি পাওয়া গেলে উক্ত যানবাহনের মালিককে উহা জীবাণুমুক্ত করণের আদেশ দেয়া যাবেএবং প্রয়োজনে উহা জব্দ ও করা যাবে।
দন্ড:
কোন ব্যক্তি সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটান বা বিস্তারে সহায়তা করেন বা সংক্রমনের ঝুঁকি গোপন করেন তাহলে ২৪ ধারা অনুযায়ী দন্ডের ব্যবস্থা রয়েছে।
দাফন:
সংক্রামক রোগে কেউ মৃত্যুবরণ করিলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের নির্দেশনা মোতাবেক দাফন বা সৎকার করতে হবে।
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন, অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।