শেখ মফিজুর রহমান সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, সাতক্ষীরা
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিচার বিভাগের অধঃস্তন আদালতের সর্বোচ্চ স্কেলভুক্ত পদে তথা বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বোচ্চ স্কেলে অর্থাৎ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদায়িত হলাম , অন্যদিকে প্রায় একই সময় আমার সহকর্মীরা অনানুষ্ঠানিক, অনাড়ম্বর কিন্তু আন্তরিক পরিবেশে আমার জন্মদিন পালন করলো। ফেসবুকের কল্যানে উভয় ঘটনায় আমার সহকর্মী, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন ভীষণ আমুদে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিছুটা আবেগ বিহবল হয়েই এই লেখা – একটি সরল আত্ম উপলব্ধি… ১৯১১ সাল। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লি এলেন বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা গোখলে – কে তিনি প্রশ্ন করলেন – আমরা তোমাদের রেলপথ-রাস্তাঘাট বানিয়ে দিচ্ছি, তোমরা শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হচ্ছো, তবু স্বাধীনতা চাও কেন? কাল বিলম্ব না করে গোখলে উত্তর দিয়েছিলেন – আমাদের আত্মমর্যাদা আছে বলেই স্বাধীন হতে চাই।
বিচার বিভাগের সদস্যদের এই আত্মমর্যাদা আছে বলেই আমরা স্বতন্ত্র, অন্যদের থেকে আলাদা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পৃথিবী তে এসেছে অস্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। ৭১ এর আদর্শ ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকার এদেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমাদের দেশটাকে ফুলের বাগানের মত গড়ে তুলতে চাই। ফুলের বাগানে যেমন নানা রঙের ফুল থাকে, এ দেশটাও তা-ই। এখানে আছে নানা ধর্মের মানুষ, আছে সমতল ও পাহাড়ের মানুষ, আমরা একসাথে সুন্দরভাবে থাকতে চাই। সেজন্য একটি উদারনৈতিক পরিবেশ আমাদের প্রত্যেকটি প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।
একজন বিচারকের ব্যক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি প্রত্যেকের রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা যেমনঃ একজন কবি শুধু বিনোদনের জন্য কবিতা লিখতে পারেন না, সমাজের বিকাশেও তার কিছু করণীয় আছে। জীবনে ঝুঁকি নিতে হয়। যারা বড় কাজ করেছেন, সবাই কোন না কোন ঝুঁকি নিয়েছেন। সবকিছু নিরাপদ নির্বিঘ্ন থাকবে, তারপর আমি একটা মহৎ কাজ করব, এটা হয় না। আপনি কঠিন সময়ে ভেঙে পড়েন, নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন কিনা সেটাই মুখ্য বিষয়। সবাইকে সত্যের উপর দাঁড়াতে হবে, দাঁড়াতে হবে ইতিহাসের সঠিক রাস্তায়। বিচারককে হতে হবে বিচারপ্রার্থীর মনমাঝি।
আসলে কর্মই ধর্ম, কর্মই জীবন, কর্মই ইবাদত। তাই যে মানুষ কর্মবীর হয়, রোগ তাকে সহজে স্পর্শ করতে পারে না। আশাবাদ, ইতিবাচকতা আর কর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার জোর উদ্দীপনা খুঁজে পায় মানুষ – খুঁজে পায় জীবনের লক্ষ্য – সর্বোতভাবে যা তাকে উদ্বুদ্ধ করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে। ফেসবুকের জগতে সামাজিক যোগাযোগ নয় দরকার প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ। এজন্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে বাড়াতে হবে নৈতিক মূল্যবোধগুলোর চর্চা। এর পাশাপাশি চাই সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। কারণ ব্যক্তি প্রধাণত শক্তিহীন – যদি না সে যুক্ত হয় সমষ্টির সাথে। এজন্য এখন যা দরকার আমাদের, সেটা হলো নিরন্তর কাজ করে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত কাজটাই মানুষকে জয়ী করে।
কাজ হলো অথৈ সমুদ্রে একটা শক্ত ভেলার মত, যা মানুষকে ভাসিয়ে রাখে। কাজ না করলে মানুষ ডুবে যায় , সমুদ্রে হারিয়ে যায়। আমাদের একটাই কর্তব্য এই জীবনকে তার সর্বোচ্চ মহিমা দান করা। একটা আনন্দময় ও কল্যানকর জীবন পার করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব সেটাই আমাদের কাম্য। মানুষের মধ্যে ভিন্নতা সত্ত্বেও খুঁজে নিতে হবে ভেদের মধ্যে অভেদ, অনাত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা। সত্য নিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে সত্যের জন্য সবকিছুকে ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনকিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক।মৌমাছি ফুলের কাছে মধুভিক্ষার কাতরতায় ফুল মুগ্ধ হয়। নিজেকে মেলে ধরে মৌমাছির কাছে। এভাবে দুজন দুজনের প্রয়োজন মেটায়। প্রকৃতিতে এই যে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক – এ এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া।
বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলা হয় সিমবায়োটিক রিলেশনশিপ (Symbiotic Relationship)। ন্যায় বিচার প্রদানের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের সাথে বিচারকদেরও এই দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। তবেই বিচারবিভাগও জনগণের মাঝে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সেতুবন্ধন গড়ে উঠবে। ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চিঠির জবাবে মনোবিজ্ঞাবী ফ্রয়েড লিখেছিলেন, “মোটা দাগে কাউকে ভালো বা মন্দ বলা যাবে না। সব মানুষের মধ্যেই ঝগড়াটে স্বভাব ও সৌহার্দ্যবোধ সমভাবে ক্রিয়াশীল।” মানুষের সৌহার্দ্যবোধকে দৃঢ় করার জন্য তাই প্রয়োজন সুশিক্ষা ও সুস্থ-সংস্কৃতির বিকাশ।
শিক্ষা মানুষেরই দরকার কারণ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। একটি গরুর বাচ্চা জন্মের পরপরই লেজ উঁচিয়ে লাফাতে থাকে। আবার যে মানবশিশু জন্মের পর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী সে-ই একসময় হয়ে উঠতে পারে বিশ্বখ্যাত কেউ। আবার ঠিকপথে পরিচালিত না হলে সে হয় কুখ্যাত অপরাধী। অর্থাৎ মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য সুশিক্ষার পথে এগিয়ে গেলে নর হতে পারে নারায়ণ। উল্টো পথে চললে নরাধম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ভোরের শপথ করেছেন। অর্থাৎ নিজের সৃষ্টিতে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন – ভেবেছেন এর নামেও শপথ করা যায়। আমরা আমাদের কাজকে, সৃষ্টিকে সেই পর্যায়ে নিতে চাই যেন এটা শিল্পে পরিণত হয়।
জুডিসিয়াল এক্টিভিজম কীভাবে আরো বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবে মানুষের জন্য মুগ্ধতা খুব ভালো কিছু নয়।মুগ্ধ হলেই প্রশ্ন থেমে যায়। নতুন উদ্যমের উৎসাহ থাকে না। মানুষ বিবশ হয়ে যায়। সক্রেটিস বলতেন – প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তুমি তোমার উত্তর পাবে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে এক অসীম শক্তির আধার। একে জাগ্রত করলেই আমি আমার জিজ্ঞাসার উত্তর পাব। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যেখানেই যেতেন তার হাতে থাকত একটি বাক্স যাতে থাকত একটি বাদ্যযন্ত্র – বেহালা। তার মতো জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানীর যদি বেহালা বাজানোর সময় থাকে, আমরা কেন নিজের বিচারকর্মের পাশাপাশি শিল্পসাহিত্য চর্চাসহ দেশ ও সমাজের জন্য সুশীল চিন্তা করতে পারব না ? আমরা দানবের সমাজ গড়তে চাই না, একটি মানবিক মহাসমাজ গড়তে চাই।
শেখ মফিজুর রহমান
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ,
সাতক্ষীরা