সব
facebook apsnews24.com
বাড়িভাড়া ও বাড়িওয়ালা শ্রেণী; প্রচ্ছন্ন এক সামন্ততন্ত্র - APSNews24.Com

বাড়িভাড়া ও বাড়িওয়ালা শ্রেণী; প্রচ্ছন্ন এক সামন্ততন্ত্র

বাড়িভাড়া ও বাড়িওয়ালা শ্রেণী; প্রচ্ছন্ন এক সামন্ততন্ত্র

আরিফুল ইসলাম

সমাজ বিজ্ঞানীরা সমাজ বিকাশের কয়েকটি ধাপ বর্ণনা করেছেন।  মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন করা হয়েছে আদিম-বর্বর সমাজ দিয়ে। এরা বর্বর-মূর্খ হলেও এদের সমাজ ব্যবস্থা ছিল সরল, বৈষম্যহীন।

প্রাইভেট প্রপার্টির (ব্যক্তিগত সম্পত্তি) উদ্ভবের সাথে সাথে তৈরি হয় দুটি শ্রেণী; দাস ও প্রভু। দাসশ্রেণীকে প্রভুরা অন্যসব পণ্যের ন্যায় সাধারণ পণ্য জ্ঞান করেন। এর অব্যবহিত পরেই শুরু হয় ভূমিদাস প্রথা। এখানেও দুই শ্রেণী; সামন্তপ্রভু বা ফিউডাল লর্ড এবং ভূমিদাস বা সার্ফ। আনুমানিক ন’শ শতাব্দী থেকে আঠারো শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত দীর্ঘসময় চলে এই প্রথা। প্রাচীন ইউরোপে ছোট ছোট জমির খণ্ডকে ফিউড (feud) বলা হতো। জমি কেন্দ্রিক অর্থনীতি হওয়ার কারণে এ সময়কালকে ফিউডালিজম বা সামন্ততন্ত্রের যুগ বলা হয়।

শুধু অর্থনীতি নয় তৎকালীন সময়ে রাজনীতি, সমাজনীতির কেন্দ্রেও ছিল জমি। শতকরা পাঁচভাগ মানুষ সমস্ত জমির মালিক। তারা অন্য জমিহীনদের খণ্ড খণ্ড জমি চাষ করতে দিতেন–চাষিদেরই বলা হতো ভূমিদাস। বিনিময়ে সামন্তপ্রভুরা আদায় করতো চড়া মূল্য। ফসল যাই ফলুক সামন্তপ্রভুরা তাদের ধার্যকৃত অর্থ আদায়ে ছিলেন অনঢ় ও খড়গহস্ত। অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে অনর্থ ঘটতো ভূমিদাসের।

যাইহোক, সামন্ততন্ত্রের বিলোপ ঘটলো ফরাসি বুর্জোয়া শ্রেণীর হাত ধরে। তারপর ইতিহাসের মহানায়ক নেপোলিয়নের উদ্ভব, ইউরোপীয় আলোকময়তা, ইতালীয় রেনেসাঁসহ অনেক ধারণার উত্থান-পতন হয়েছে। মানুষ সভ্য হয়েছে, সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ছে। সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু ভূমি কেন্দ্রিক অর্থনীতির কি বিলোপ হয়েছে?

হালের বাংলাদেশে চলমান রয়েছে বাড়ি কেন্দ্রিক অর্থনীতি। মুখোশ উন্মোচন হয়েছে দুটি শ্রেণীর; বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া। বাড়িওয়ালা শ্রেণী তাদের নির্দিষ্ট বাড়ি বা ফ্লাটগুলোতে নির্দিষ্ট মূল্যে থাকতে অনুমতি প্রদান করেন ভাড়াটিয়াদের। তার উপর ধার্যকৃত অর্থ গুনতে হয় মাসের নির্দিষ্ট সময়ে। এই পদ্ধতির হেরফের হলে বিষোদগার করতে বাধে না বাড়িওয়ালা শ্রেণীর। কখনো বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি কখনো ভাড়া বৃদ্ধি। সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাদের একক অধিকার! এ যেন ‘বাড়ি যার, সিদ্ধান্ত তার’। এ যেন পোশাক বদলে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মধ্যযুগের সেই সামন্ততন্ত্র।

তবে এ সমস্যার সমাধানকল্পে নব্বইয়ের দশকেই করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় বিধিমালা। ভাড়াটিয়া আইন ১৯৯১ অনুযায়ী মানসস্মত বাড়িভাড়ার কথা বলা হয়েছে। বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫ ভাগের বেশি হতে পারবে না বাৎসরিক ভাড়া। এক মাসের অতিরিক্ত অগ্রিম ভাড়া নেওয়া যাবে না। ভাড়াটিয়া উচ্ছেদে মাসিক চুক্তির ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে পনের দিন এবং বাৎসরিক চুক্তির ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে ছয়মাস পূর্বে নোটিশ দিতে হবে। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সম্পর্ক হবে জবাবদিহিতামূলক। এসব বিধি না মানলে ভাড়াটিয়া ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক’ এর সহায়তা নিতে পারবেন। সাধারণত সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলো এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তিনি দোষীকে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ড  প্রদান করতে পারেন।  তবে এসব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও বাড়িওয়ালারা অল্পই কেয়ার করছেন আইনকে। আবার ভাড়াটিয়া আইন কিংবা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের ব্যাপারে অনেক ভাড়াটিয়াই অসচেতন। কতজনই-বা জানেন একটি জরিপ চালিয়ে দেখা যেতে পারে।

করোনা মহামারির সময়েও ভাড়াটিয়া নিগ্রহ বন্ধ হচ্ছে না। মহামারির কারণে আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিংবা আয় হ্রাস পেয়েছে অনেক শ্রেণী পেশার মানুষেরই। কিন্তু বাড়িভাড়া কমেনি। বরং বেড়েছে বাড়িওয়ালাদের উৎপীড়ন ও অসহিষ্ণু আচরণ। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমণ্ডিসহ কয়েকটি এলাকায় ভাড়া দেওয়ায় বিলম্ব হওয়ায় ভাড়াটিয়া শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেটসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও বিনা নোটিশে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের সংবাদ প্রতিনিয়তই আসছে গণমাধ্যমে। এই সামন্তবাদী শ্রেণীর অনেক নিগ্রহ হয়তো আমাদের গোচরীভূতই হয়নি। আইন থাকলেও ভাড়াটিয়ারা আদৌ কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন কিনা ভাড়াটিয়া আইনের দ্বারা, সে ব্যাপারে সঙ্কা রয়েই যায়। ঐতিহাসিক উইল ডুরান্টের ভাষায়, আইন হলো মাকড়শার জালের মতো, ছোট ছোট পোকামাকড় আটকাতে পারে, বড় পোকাদের ঠেকাতে পারে না। বাড়িওয়ালা তো সামন্তপ্রভু; বড়পোকা। রুখবে তোমায় সাধ্য কার!

সুতরাং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সজাগ অবস্থান এবং সনাতন আইনের সাথে কিছু বিধি সংযোজন করে তার প্রয়োগই পারে ভাড়াটিয়া নিগ্রহ রুখতে। সংযোজনের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রস্তাবনা নিম্নরুপ-

১. মানসস্মত ভাড়া কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে নির্ধারণ করা, যাতে মহামারিকালে বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া উভয়ের জন্য সুবিধাজনক হয়।

২. ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে বাড়িওয়ালাদের সহিষ্ণু আচরণ।

৩. নির্দিষ্ট সময়ে ভাড়াটিয়া ভাড়া প্রদানে ব্যর্থ হলে উচ্ছেদের কমপক্ষে একমাস পূর্বে নোটিশ দেওয়া।

৪. উচ্ছেদকালে ভাড়াটিয়া অনুপস্থিত থাকলে তার মালামাল সযত্নে রাখা কিংবা ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক’ এর মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা।

৫. উভয়ের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতামূলক আচরণ নিশ্চিত করা।

তবে, আইন-আদালত, নিন্দা-প্রতিবাদ ফলপ্রসূ হবে না, যদি বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার শ্রেণীবৈষম্যমূলক মনোভাবের পরিবর্তন না ঘটে। ‘সুপিরিয়র-ইনফেরিয়র’ মনোভাব বদলাতে হবে। মানুষকে হয়ে উঠতে হবে অধিকতর মানবিক প্রাণী। অন্তর্নিহিত বদ্ধমূল ধারণার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।  তবেই হবে সুস্থ, বাসযোগ্য পৃথিবী।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj