অর্থনীতির চাকায় দরিদ্র পিষ্ট হলে সে দায় কার?
সারাবিশ্বে করোনা মহামারীর তান্ডব। দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে প্রত্যহিক জীবনের কার্যপ্রণালী । সংক্রমণ আর মৃত্যু বেড়েই চলেছে, অন্ধকারের বুক চিরে প্রবেশ করছি ঘোর অন্ধকারে! জনজীবন স্থবির হয়ে অনেকটাই প্যারালাইসিসে আক্রান্তের মতো থেমে অাছে। কিন্তু শ্রমকলের চাকা থেমে নেই, শ্রমিক কাজ করে চলেছে উদয়স্ত। কৃষকের উৎপাদন বন্ধ নেই, লাঙ্গল মেরে, রোদে পুড়ে ফসল উৎপাদনে তারা ক্লান্ত হননা কখনোই । জীবনের ঝুকি নিয়ে শ্রমিক কাজ করে পণ্য উৎপাদন করে যতসামান্য মূল্য পেয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ সেই পণ্য বিক্রি করে অারো কয়েকটি শ্রমকলের মালিক বনে যাচ্ছেন চারদেয়ালের সুরক্ষাব্যূহ থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইস ব্যাবহার করে ভিডিও কনফারেন্সে নির্দেশনা দেওয়া মালিকশ্রেনী। আবার সেই একই পণ্য রপ্তানি করে সরকার বলছে আমরা এতোএতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছি ।
কৃষক সর্বস্ব বিনিয়োগ করে চাষ করে ফসল উৎপাদন করছে। নামমাত্র মূল্যে তাদের থেকে ফসল কিনে চড়া দামে বিক্রি করছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। অাবার সেই ফসলের বড়াই করেই সরকার বলছে অামরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সত্যজিৎ রায়ের তেতাল্লিশের মন্বন্তর অবলম্বনে ‘অশনিসংকেত’ চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়ছে;চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘কৃষক লাঙ্গল মেরে ফসল উৎপাদন করে আর আমরা তার ঘাড়ের ওপর বসে খেয়ে যাই’। যাইহোক, এর বিস্তর বর্ণনায় অামি যাব না।
তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানান দিয়েছে, মহামারি করোনার শনাক্তকরন পরিক্ষা অার সরকারি খরচে হচ্ছে না কারন কারো আক্রান্ত হওয়া এটা কেবল-ই তার নিজস্ব ব্যাপার। নিজের রোগ শনাক্তকরন পরিক্ষাও হবে নিজ খরচে। সরকার কেন এর দায়ভার বহন করবে?কথায় যুক্তি রয়েছে নিশ্চয়ই, যেহেতু অাহামরি বেশী খরচও নির্ধারণ করা হয়নি।
তবে এক্ষেত্রে খরচ বহন করা উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য হয়তো বোঝা হয়ে দাড়াবে না। সমস্যায় পড়বে একটি শ্রেনী। ঐ যারা পণ্য অার ফসল উৎপাদন করে; সেই নিম্নবিত্ত শ্রেনী। যারা এদেশের অর্থনীতির চাকা এখনো সচল রাখতে সেই গাড়ির গাড়োয়ানের ভুৃমিকা পালন করছে। তারা প্রকান্ড মহামারির ঝড়ে ডুবতে যাওয়া অর্থনীতির জাহাজে একেকজন মাঝি সিন্দাবাদ। অথচ সেই অর্থনীতির চাকায়-ই তাদের পিষতে যাচ্ছি অামরা! তাদের প্রতি এতটুকু দায়ভার অমাদের না থাকলে তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে কিভাবে অামরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি! বিশ্ববাজারে সুনাম অর্জন করি! তারা তো পণ্য উৎপাদনে দায়বদ্ধ নয়।
যাদের উৎপাদিত ফসল খেয়ে অামরা বেঁচে অাছি, যাদের উৎপাদিত ফসলের জন্য অামাদের বিশ্বের কাছে হাত পাততে হয়না, মাথা উচু করে বলতে পারি অামরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের প্রতি অামাদের দায় নেই?
বলা হয়, ঈশ্বর শ্রমের বিনিময়ে আমাদের কাছে সবকিছু বিক্রি করেছেন তবে কি কভিড পরিক্ষাটুকু বিক্রি করেও আবার ফিরিয়ে নিলেন! প্রকৃতপক্ষে, কৃষক শ্রমিকেরা আমাদের উপর সহানুভূতি প্রদর্শন করছে, আমরা দু’হাত পেতে তা গ্রহণ করে অাবার ভুলে যাচ্ছি হরদম।
শুধু দায় ই নয় বরং আমরা তাদের কাছে ঋণী। শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য কিংবা মহামারির তান্ডবে জীবনের ঝুকি সত্বেও তারা কথনো বলেনি, অামরা উৎপাদন বন্ধ করে দিবো, আমরা ফসল ফলাবো না। তাহলে অর্থনীতির চাকায় মরিচা পড়ে যেতো! তবে সেটা আমাদের কাছে কাম্যও নয়। সচল থাকবে দরিদ্রদের জীবনের চাকা,সচল থাকবে অর্থনীতির চাকা। সেটি কাম্য।
আরিফুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়