গত কিছু দিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যে বিষয়টা সবথেকে চোখে পরছে তা হল বাংলা বানান এর প্রচলিত এবং শুদ্ধ রুপ নিয়ে সমালোচনা। কেউ কেউ বিষয়টা নিয়ে যেমন বিদ্রূপ করছেন আবার অনেকে এর পক্ষে জোর যুক্তি দেখাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির কাজ কর্ম নিয়েও অনেকে মন্তব্য পর্যন্ত করছেন। এমন মন্তব্য আমরা শুনি যে, “হঠাৎ করে তারা একটা বানান বলে দিলো আর আমাদেরকে তা মেনে চলতে হবে!”
আমার মত সাধারন মানুষ পরেছেন সব থেকে বিপদে। দু কলম লিখতে গেলে কোথায় যে আবার কোন ভুল হয়ে যায়! আমার একজন বন্ধু জানালো সে এবার কোরবানির পশু কিনতে যাবে না। গরু এবং গোরুর বিতর্ক শেষ না হওয়া অব্দি। ঘটনা হাস্যকর মনে হলেও, আসলেই ব্যাপারটা আর হাস্যরসের মাঝে নেই। প্রথম আলোতে এই “গরু নাকি গোরু” বানান বিতর্ক নিয়ে তারিক মনজুর খুব ভালো একটা লিখা লিখেছেন। পড়ে দেখতে পারেন।
যারা বানান নিয়ে ঝামেলা এড়াতে চাচ্ছেন তাদের যুক্তিও মন্দ না। বাংলা একাডেমির বানান মেনে লিখতে হবে তার কি দরকার আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সময় কি আর বাংলা একাডেমি ছিল। আর দুটা তিনটা বানান ভুল লিখলেই বা কি আসে যায়। তিন বানান ভুলে এক নম্বর তো আর কাটা যাবে না! এই মধ্য বা বুড়ো বয়সে এসে নতুন করে বানান শিখতে গেলেও তো বিপত্তি।
সত্যি এই সকল কথাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ব্যাকরণ এবং বানানের মাঝের যোগসূত্র নিয়ে হয়ত আলোচনার দরকার আছে, কিন্তু আমারা সে দিকে অগ্রসর হব না। বরং আমরা দেখতে চাই “বাংলা একাডেমি আইন ২০১৩” আইনটি। আসলেই কি বাংলা একাডেমির বানান মেনে চলা আমাদের দরকার কিনা, এর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা আছে কিনা। লেখাটি দীর্ঘ না করার উদ্দেশে আমরা শুধু প্রাসঙ্গিক কয়েকটি ধারা দেখবো।
আইনটির প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু Bangla Academy Ordinance, 1978 রহিতপূর্বক সংশোধনসহ উহা পুনঃপ্রণয়ন ও সংহত করিবার উদ্দেশ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হল।
ধারা ৩ এ বলা হয়েছে বাংলা একাডেমি হবে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং লিগ্যাল পার্সন।অর্থাৎ এটি সম্পত্তি অর্জন এবং হস্তান্তর করতে পারবে, একাডেমি যে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।
বাংলা একাডেমির কার্যাবলি সম্পর্কে ১০ ধারায় বলা হয়েছে,
- জাতীয় আশা আকাঙ্খার সাথে সঙ্গতি রেখখে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসার সাধন; দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও সম্প্রসারণের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে এবং একই সাথে, বাংলা ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে জীবনের সর্বস্তরে এবং জ্ঞানচর্চার সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন, ব্যবহার ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সহায়তা প্রদান;
- বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, পরিভাষা ও ব্যাকরণ রচনা, রেফারেন্স গ্রন্থ, গ্রন্থপঞ্জি এবং বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ প্রণয়ন, প্রকাশন ও সহজলভ্যকরণ;
- বাংলা শব্দের প্রমিত বানান ও উচ্চারণ নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;এছাড়াও আরো অনেকগুলো কার্যাবলির বিবরন প্রদান করা হয়েছে।
আমরা দেখছি বাংলা একাডেমি বানান সম্পর্কিত যেকোন বিষয় অবশ্যই প্রকাশ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। দেশের নাগরিক হিসেবে তা অনুসরন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বটে।
বাংলা আমাদের রাষ্ট্র ভাষা, সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। অবশ্যই তা শুদ্ধ বাংলাকেই নির্দেশ করে।
আমাদের উচিত হবে শুধু মাত্র বানান নয় বরং আমাদের মাতৃভাষা ব্যবহার, প্রয়োগে বিশেষ করে বিকৃত উচ্চারণ এবং অন্য ভাষার সাথে মেশানো থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করা। অবশ্যই আমরা অন্য ভাষা শিখবো তবে বাংলা ভাষার যে গৌরবময় ইতিহাস; ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেবার যে ঐতিহাসিক বিজয়গাঁথা তা যেন আমরা ভুলে না যাই।
পুনশ্চঃ লেখায় বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা মার্জনীয়।
লেখকঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব। শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট। ইমেইলঃ ghalibhit@gmail.com