সব
facebook apsnews24.com
ধর্ষণ, ভিকটিমের চরিত্র, আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা! - APSNews24.Com

ধর্ষণ, ভিকটিমের চরিত্র, আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা!

ধর্ষণ, ভিকটিমের চরিত্র, আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা!

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

একটি বাস্তব কেইস ষ্টাডি দিয়েই লেকাটি শুরু করি। ভারতে ধর্ষণ অপরাধটি ঘটে গুজরাট রাজ্যের গান্ধীনগর শহরে আসামি ভারওয়াদার গৃহে। দুজন বালিকা তাদের বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে ওই গৃহে বিকেল বেলা যায়। বান্ধবী বাসায় তখন ছিল না, তবু মিথ্যা কথা বলে বান্ধবীর বাবা বালিকা দুজনকে বাসার মধ্যে নিয়ে আসে এবং ধর্ষণ করার প্রস্তুতি নেয়। একজন বালিকা পালিয়ে যায়। কিন্তু অন্যটি ধর্ষণের শিকার হয়। বালিকাটির মা-বাবা তখন অন্যত্র ছিল। পাঁচ দিন পর তাঁরা গৃহে ফিরলে বালিকাটি ঘটনা প্রকাশ করে এবং তার মা-বাবা সংগত কারণে তা গোপন করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে স্থানীয় মহিলা সমিতির সভানেত্রী ঘটনাটি জানতে পারেন এবং তাঁর উদ্যোগে আসামির বিরুদ্ধে মামলা হয়। ভিকটিম বালিকাকে একজন ডাক্তার পরীক্ষা করেন এবং তিনি যৌন নিপীড়নের আলামত পান। উভয় বালিকা আদালতে সাক্ষ্য দেয়। পাঠক! নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে মামলাটিতে বালিকা দুটি ও ডাক্তারের সাক্ষ্য ছাড়া আসামির বিরুদ্ধে আর কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ছিল না। দায়রা আদালত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তা গুজরাট হাইকোর্ট ও তারপর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখেন।

রায়ের প্রারম্ভেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদ্বয় নিজেদের প্রশ্ন করেন, ধর্ষিতার সাক্ষ্যের সমর্থনে কতটা সাক্ষ্য প্রয়োজন? উত্তরে বলেন, ‘ভারতীয় সামাজিক কাঠামোতে সমর্থক সাক্ষ্য ছাড়া যৌন অপরাধের ভিকটিমের সাক্ষ্য বিশ্বাস না করার নীতি হচ্ছে ক্ষতের ওপর অপমানের জ্বালা যোগ করা। একজন ধর্ষিতার অভিযোগ কি দেখতে হবে এমন এক চশমার ভেতর দিয়ে যার কাঁচ দুটি সংশয়, অবিশ্বাস ও সন্দেহ দ্বারা রঞ্জিত? এই যদি করা হয়, তবে সেটা হবে পুরুষশাসিত সমাজে দাম্ভিক পুরুষের ঔদ্ধত্য ন্যায়সংগত বলে মেনে নেওয়া।’

অল ইন্ডিয়া রিপোর্টসের সুপ্রিম কোর্ট অংশে ৬৫৮ পৃষ্ঠায় একটি সিদ্ধান্ত এরকম যে, ‘বিরল ঘটনাগুলোর মধ্যে বিরলতম ঘটনা ছাড়া কোনো ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের মোকদ্দমা বিচারকালে ভিকটিমের সাক্ষ্যের সমর্থনে সাক্ষ্য দাবি করা নারীত্বের অপমান। তার যাতনায় যোগ করা হবে বিদ্রæপ, যদি বলা হয় তোমার দুঃখের ঘটনা বিশ্বাস করা হবে না, যদি তার সমর্থনে অন্য কোনো সাক্ষী না থাকে।’

আমাদের বিচারপতি গোলাম রব্বানী স্যার একটি রায়ে উল্লেখ করেন যে, যারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ছাড়া তাদের কোনো সাক্ষী নাই, তাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য এই হবে যে, সে আল্লাহর নামে চারবার শপথ করে বলবে যে সে অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চমবার বলবে, ‘সে মিথ্যাবাদী হলে তার ওপর নেমে আসবে আল্লাহর অভিশাপ।’ তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত করা হবে যদি সে চারবার আল্লাহর নামে শপথ করে সাক্ষ্য দেয় যে তার স্বামীই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবার বলে, ‘তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার নিজের ওপর আসবে আল্লাহর ক্রোধ (কোরআন, ২৪ : ৬-৯)।

সুতরাং স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত ব্যভিচারের অভিযোগের সাক্ষী স্বামী ছাড়া কেউ না থাকলে স্বামীকে চারবার শপথ করতে হবে, অভিযোগের পক্ষে এবং পঞ্চমবার নিজের ওপর অভিশাপ আহŸান করতে হবে যদি সে মিথ্যা বলে। এটা স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রমাণ। কিন্তু স্ত্রী যদি ওইরূপ চারবার শপথ করে তার নির্দোষিতার পক্ষে এবং পঞ্চমবার আহŸান করে অভিশাপ যদি সে দোষী হয়, তখন আইনের দৃষ্টিতে স্ত্রী নিরপরাধ হবে; অর্থাৎ কোরআনের অনুশাসন এই যে একজন স্ত্রীলোকের সাক্ষ্যই তার চরিত্রের পবিত্রতা বিষয়ে চূড়ান্ত সাক্ষ্য। রায়ে বিচারপতি উল্লেখ করেন যে, উপরিউক্ত আয়াতের অন্তর্নিহিত অনুশাসন যৌন অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যৌন অপরাধের কেসে ফরিয়াদির একমাত্র সাক্ষ্য বিশ্বাস করতে আইনে কোনো বাঁধা নেই। কেবল তা-ই নয়, ফরিয়াদিকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে শুধু বিরল ঘটনাগুলোর মধ্যে বিরলতম ঘটনা ছাড়া যেখানে সমর্থনকারী সাক্ষ্যের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।

অথচ আমাদের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণতঃ ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ঐরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।

বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলোতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে কতটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কী ছিল তার কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র মামলা, যা ১৩ বিএলসি ২০০৮ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তার শিশুসহ তার কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌনসম্পর্কের ইতিহাসকে তার ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় ‘ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।’

অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫, মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’

কাজেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৮৭২ এর ধারা ১৫৫ এর ৪ উপধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে। কাজেই ১৫৫ এর ৪ এর বিধান বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় কি?

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj