রায়হান কাওসার
সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় ‘ফোর্থ স্টেট’। অর্থাৎ সংসদ, সরকার ও বিচারবিভাগ এর পরেই সংবাদ মাধ্যমকে স্থান দেওয়া হয়েছে। একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব অদ্বিতীয়। রাষ্ট্রের অন্য তিনটি অঙ্গের মত সংবাদমধ্যমও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সংবাদমাধ্যম ছাড়া একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। আর প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলেছে নানা গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। সংবাদমাধ্যমের বদৌলতেই আমরা এসকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। সংবাদমাধ্যম ইতিহাস ও ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজেরও অন্যতম উৎস। যেমন- ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভিডিও গুলি দেখলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কে আমাদের শত্রু ছিল আর কে ছিল আমাদের মিত্র; কি অবস্থায় ছিলাম আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন দিনগুলিতে। এছাড়াও বর্তমানের ভিত সৃষ্টি হয় অতীত দিয়েই। সুতরাং আমরা যদি অতীতকে জানতে চাই, তাহলেও বুঝতে পারি সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব কতটুকু।
ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাতেও সাংবাদিকদের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনেক। তাদের কাজের কোন রুটিন নেই। বিভিন্ন ঘটনার পিছনে ছুটতে হয় রাত-বিরাতে। প্রতিনিয়ত ছুটে চলতে হয় নানা ঘটনার খবর ও তথ্য সংগ্রহহের জন্য। আর একজন ভাল সাংবাদিকই পারেন মানুষের বিবেককে শাণিত করতে এবং সমাজের রুচি ও সংস্কৃতি তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে। সমাজের নানা অন্যায়-অবিচারের খবর সাংবাদিকরাই পৌছে দেন নাগরিকদের কাছে- যার ফলে প্রচলিত আইন-আদালতের মাধ্যমে আমরা ঐ সকল অন্যায়-অবিচারের বিচার করে থাকি; যে কোন জাতীয় সমস্যা ও সুযোগের ব্যাপারে সচেতন হয়ে অগ্রীম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।
পৃথিবীতে যতদিন মানব সমাজ আছে, ততদিন রাজনীতিও থাকবে। আর কেউই রাজনীতির বাইরে নয়। সুতরাং সাংবাদিকদের মধ্যেও কেউ আওয়ামীলীগপন্থী, কেউবা বি এন পি পন্থী থাকবেই। আমরা যতই বলি না কেন সাংবাদিকদের একেবারে রাজনীতির বাইরে রাখব- সেটা সহজ হবে না। তবে রাজনীতি ও সাংবাদিকতা- এই দুইটার মধ্যে একটা ন্যূনতম নৈতিক দুরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে- সেটা আমাদের স্বার্থেই। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়, পেশাদারিত্বের জায়গায় পেশাদারিত্ব- এই কথাটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। রাজনীতির মোহে অন্ধ হয়ে কোন সাংবাদিকের উচিত হবে না সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যা কে সত্য হিসেবে প্রচার করা। কারণ সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যার উপর একটি রাষ্ট্রের নাগরিক সহ বিদেশীরাও নির্ভর করে থাকেন। সংবাদমাধ্যমকে খুব বেশি রাজনীতিকরণ করা যাবে না। আমাদের সাংবাদিকদের যদি দুইটা বিষয়ের (চাকরি ও মানসম্মত বেতন) নিরাপত্তা দেওয়া যায়, তাহলে তারা তাদের পেশাদারিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হবে আরও ভালভাবে।
নিরপেক্ষ সংবাদ যদি কোন বিশেষ দলের অনিয়ম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যায়, বা সমাজের বিশেষ কিছু ব্যক্তিদের অপ-কর্মের বিরুদ্ধে যায়, অনেক সময় দেখা যায় ঐ সাংবাদিককে বরখাস্ত বা বিশেষ পন্থায় হয়রানি করা হয়। আমরা যদি এসকল বিষয়ে একজন সাংবাদিককে নিরাপত্তা দিতে পারি, সাংবাদিকরা তাদের পেশায় আরো বেশি অবদান রাখতে পারবেন। আমাদের দেশের সাংবাদিকদের একেবারেই পক্ষপাতদুষ্ট বা অপেশাদার বলা যাবে না। আমাদের দেশের সাংবাদিকরা তাদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে যে সেবা দিচ্ছেন, সেটি অন্যান্য দেশের তুলনায় খারাপ নয়। তবে অনেক সময় নানা বাধা বা নিয়ন্ত্রণের কারণে তাঁরা পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না।
আমাদের দেশের সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিকেও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। সকল সাংবাদিক সংগঠনগুলোর উচিত একটি যৌথ ট্রেনিং ও রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা যাতে তারা নবীনদের সাংবাদিকতা বিষয়ে ট্রেনিং দিতে পারেন এবং সিনিয়ররাও নিজেদের মধ্যে তাদের মেধা ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। এছাড়াও, সাংবাদিক ভাইদের দেশপ্রেমিক হতে হবে। সবার চেয়ে দেশ বড়, দেশের জনগণের স্বার্থই বড়। তাদের সব সময় ভাবতে হবে- জনস্বার্থ আগে, দলীয় স্বার্থ পরে। রাজনীতির সাথে সাংবাদিকদের পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকতেই পারে, তাই বলে সেই রাজনীতি যেন অন্ধ না হয়, সেই রাজনীতি যেন অন্যায় না হয়, সেই রাজনীতিতে যেন একজন দু:খী মায়ের অভিশাপ জড়িয়ে না থাকে, সেই রাজনীতিতে যেন অধিকার বঞ্চিত হাজারো মানুষের হাহাকার ও বেদনা জড়িয়ে না থাকে। তবেই একজন সাংবাদিকের কর্ম ও জীবন হবে স্বার্থক, তিনিই হবেন মর্তের পৃথিবীতে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ানোর মত পূজনীয় একজন, তিনিই হবেন অনেকের মধ্যে অন্যতম, বরেণ্য।
রাজনীতিবীদদের উচিত হবে জাতির বিবেক বা একটি দেশের প্রতিচ্ছবি- সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের রাজনীতিকরণ না করা এবং সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা ও মানসম্মত বেতন নিশ্চিত করা যাতে তারা একটি সফল ও আদর্শ জাতি গঠনে তাদের সর্বোচ্চটুকু উৎসর্গ করতে পারেন।
লেখকঃ রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।