সংশোধনী আনতে প্রয়োজন কার্যকর সংলাপ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা নিয়ে হাইকোর্টের একটি রুল বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি সমঝোতা চেষ্টার উদ্যোগকেই নতুন করে মনে করিয়ে দিল। বিষয় ছিল মত প্রকাশ, বাক্ ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা। সম্পাদক পরিষদ বরাবরই এই আইনের আটটি ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। তারা প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া দেশ ও বিদেশসহ ১০টি ইইউ ওই আইনের চারটি ধারা ও টিআইবি নয়টি ধারা নিয়ে উদ্বেগ বা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন এসে পড়ায় এ-সংক্রান্ত আলোচনা আলোর মুখ দেখেনি বরং মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এখন একটা বিরতিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ওই আইনের কেবল ২৫ ও ৩১ ধারা কেন অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে না মর্মে রুল জারি করেছেন। দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আইনী মর্যাদা ও গুরুত্ব কোথায় আছে, সেটা অসম্পূর্ণ হলেও নতুন করে খতিয়ে দেখার জন্য এটি একটি ভালো অগ্রগতি।
বিশ্বের নানা দেশে জাতিরাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনক্ষণগুলো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উদ্যাপন করে থাকে। এর একটা অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া ও নিজদের শুধরে নেওয়া। সরকারের নজরে রাখা উচিত, সব সময় সব বিষয়ে সম্পাদক পরিষদও এককাট্টা হয়ে অবস্থান নিতে পারে না। গত এক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন–সহযোগী বা ঢাকার কূটনীতিকেরা এতটা নির্দিষ্টভাবে অন্য কোনো আইনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত আলোচনা ও পর্যালোচনা সাপেক্ষে দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে—এমনটি প্রত্যাশিত।
নীতিনির্ধারকদের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মুক্তির সংগ্রামে গণমাধ্যম বরাবরই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে এবং তা অব্যাহত আছে। সমকালীন বিশ্বে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মাধ্যম আমাদের রাস্ট্রীয় প্রথাগত নিরাপত্তা হুমকিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে অবশ্যই সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের আইনসভা এমন অনেকগুলো আইন পাস করেছে, যা কোনো না কোনো মাত্রায় বাক্স্বাধীনতার ওপর বিরূপ ও সুস্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০১৩ সালের আদালত অবমাননা আইন তেমনই একটি উদাহরণ। বাক্স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আইনটির কয়েকটি ধারা হাইকোর্টে বাতিল হলো। তৈরি হলো একটি শূন্যতা। যেহেতু আইনটির সঙ্গে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত, তাই এ নিয়ে সংসদের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ আমরা এখনও দেখি না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুধু দুটি ধারার বিষয়ে আদালত রুল জারি করেছেন সত্য, কিন্তু আমরা মনে করি, আরও অন্তত পাঁচ-ছয়টি ধারা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নিশ্চয়তা দেওয়া ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার’ সঙ্গে একটি সংঘাত তৈরি করেছে। উপরন্তু ফৌজদারি অপরাধ ও আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো ঠিক কী করলে কোন অপরাধ সংঘটিত হবে, তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা থাকতে হবে। কিন্তু উল্লিখিত ধারাগুলোতে সুস্পষ্টভাবে অপরাধসমূহকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি যা অসম্পূর্ণ বটে। ফলে এসব ধারার অপব্যবহারের মাধ্যমে পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে হয়রানি ও মিথ্যা কেস করার সুযোগ রয়েছে। এটা একধরনের ভীতির ও আশংকাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার ফলে সংবাদমাধ্যমে একটা বাড়তি সতর্ক হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
মুজিব বর্ষ ঘিরে আশা করব, এই রুলকে বিবেচনায় নিয়ে বা না নিয়ে সরকার সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে খোলামনে আলোচনার মাধ্যমে এর একটা যৌক্তিক সমাধান ও পরিণতি নিশ্চিত করবে। ঝুলিয়ে রাখলে বিষয়গুলো কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাবে না। ক্ষতিগ্রস্থ হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, গনতণ্ত্র, ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
এপিএস অনলাইন