থমকে গেছে পুরো পৃথিবী। সারা বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা মহামারী। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব।জনজীবন হয়ে পড়েছে ঘরবন্দী। চিনের উহান প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাস( কোভিড- ১৯) এর বিস্তার শুরু হলেও বর্তমান দুইশত এর অধিক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যুর মিছিল যেনো থামছেই না।বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। প্রথম দিক অবস্থা কিছুটা ভাল থাকলেও, দিন দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে গড়ে প্রায় ২০০০ হাজারের বেশি মানুষ।সেই সাথে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ।বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে।দেশের এই ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে কিছু অসাধু, মুনাফা লোভী ব্যাবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে, নিত্ত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস,ঔষধ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সহ বিভিন্ন পণ্যের দাম দ্বিগুণ – তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে,যা সাধারণ জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।সেই সাথে বাজারে যেন নকল পণ্যের মেলা বসেছে, করোনার সময় জরুরি একটি পণ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথাই ধরা যাক,যা হাত পরিষ্কার বা জীবাণুনাশ করতে ব্যাবহার করা হয়।কিন্তু বর্তমান বাজারে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন নকল ও নিম্নমানের স্যানিটাইজার সামগ্রী, যা করোনার মতো ভাইরাসকে ধ্বংস তো করতে পারবেই না বরং রয়েছে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। একজন ভোক্তা হিসাবে আপনার করণীয় কি??বা, আপনি বাজারে গিয়ে নকল পণ্যে দেখলেন বা ক্রয় করলেন তখন আপনার করণীয় কি??
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে বা ভোক্তা- অধিকার সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে।যার ফলে আমরা কোন প্রতিবাদ করতে পারছি না।ভোক্তা -অধিকার সংরক্ষন,ভোক্তা- অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ ও তৎসংশিষ্ট অনান্য বিষয় বিধান করার লক্ষ্যে, সরকার “ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইন – ২০০৯” জাতীয় সংসদে পাশ করে। এ আইনের অধীন একজন ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হলে আইন অনুযায়ী সে প্রতিকার পেতে পারে।
জনসচেতনতা ও পর্যাপ্ত প্রচারের অভাবে “ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষন আইন-২০০৯” সম্পূর্ণ কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না।তবে উন্নত দেশগুলো ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই সচেতন।ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগেই ভোক্তা অধিকার আইন বাস্তবায়িত হয়েছে,যার ফলে ঐ সকল রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে এসেছে।নব্বইয়ের দশকে আমেরিকার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।১৯৯৪ সালে ইসা লিসবেক নামের এক মার্কিন নারীর শরীরে ম্যাকডোনাল্ডসের ৫০ সেন্টের কফি পড়ে পুরে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণবাবদ দিতে হয়েছিলো ছয় লাখ ডলার! শুধু স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কফি দেওয়ার জন্য।(তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ১৫ মার্চ ২০১৭) ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো মূলত পঞ্চাশের দশকে মার্কিন নাগরিক রালফ নাদের হাত ধরে।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ, ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত এক ভাষণে বলেন, যদি ভোক্তাকে নিম্নমানের পণ্য বিক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়, পণ্যের দাম যদি ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়, যদি পণ্য ভেজাল এবং অকার্যকর প্রমানিত হয়, ভোক্তা যদি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহনে অসমর্থ হন, তাহলে তার অর্থের অবমূল্যায়ন হয়।ভেক্তার স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় এবং সেই সাথে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হয়।( তথ্যসূত্র : প্রথম আলো)দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষন আইন -২০০৯ পাশ হয়েছে। প্রথমেই আমাদের কে বুঝতে হবে ভোক্তা কে,,ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ধারা ২(১৯) অনুযায়ী, ভোক্তা হলো- এমন কোন ব্যাক্তি যিনি,*মূল্য পরিশোধ বা মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে কোন পণ্য ক্রয় করেন* সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকীতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয়কারী*আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয়কারী *কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয়কারী*ক্রেতার সম্মতিতে ক্রীত পণ্য ব্যবহারকারী।অর্থাৎ বাংলাদেশে যদি ১৮ কোটি জনসংখ্যা থাকে তাহলে ভোক্তা ও আছে ১৮ কোটি।
এবার আসি একজন ভোক্তা যে যে অবস্থার পরিপেক্ষিতে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে-*কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধি দ্বারা কোন পণ্য মোড়কাবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওজন,পরিমাণ,উপাদান, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য,ব্যাবহার বিধি, উৎপাদনের তারিখ, প্যাকেটজাত করণের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্ট ভাবে লেখা না থাকলে* মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করলে* সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা হলে* ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে ঔষধ বা সেবা বিক্রয়*খাদ্য নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রন*ভেজাল পণ্য বা ভেজাল ঔষধ বিক্রি* অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ* মিথ্য বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা* ওজনে কারচুপি,দৈর্ঘ্য পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতাতে কারচুপি* পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন,মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয় যা সেবা গ্রহীতার জীবন বিপন্ন করতে পারে।এ সকল অপরাধের জন্য কোন বিক্রেতা বা বিক্রয় কারী প্রতিষ্ঠান ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এর ধারা ৩৭-৫৬ পর্যন্ত দন্ড ও জরিমানা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে আমরা সচেতন না হওয়ার দরুন, এত বড় শাস্তির কথা উল্লেখ থাকলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছি না। বরং বার বার আমরা প্রতারনার স্বীকার হতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।আইন না জানার কারনে, আমরা অনেক সময় ভেজাল বা নকল পণ্য কিনছি কিন্তু কোন প্রতিবাদ করতে পারছি না বরং প্রত্যহ আমরা প্রতারণার স্বীকার হচ্ছি বা অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেও মুখবুঝে সহ্য করতে হচ্ছে আইন না জানার কারনে।
বর্তমান যেহেতু করোনা মহামারী চলছে স্যানিটাইজার সামগ্রীর কথাই ধরা যাক,ধরুন, আপনি ব্যস্ততম এলাকার কোন একটি দোকান থেকে হ্যান্ড- স্যানিটাইজার কিনলেন।
কেনার পর আপনি দেখলেন যে স্যানিটাইজার সম্পূর্ণ ভেজাল যা জীবানুনাশ করতে অকার্যকর।এমতাবস্থায় আপনার করণীয় কি?? বা আপনি কিভাবে এর প্রতিকার পেতে পারনে?? এর প্রতিকার আপনি ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ আইনের অধিন অভিযোগ দায়ের করলে পেতে পারেন। ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এর ধারা -৪১ এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রি করলে বা করিতে প্রস্তাব করিলে ঐ ব্যক্তি অনূর্ধ্ব(৩)বৎসর কারাদণ্ড বা অনাধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
কিন্তু আমাদের উক্ত আইন সম্পর্কে আমাদের ধারনা না থাকার কারনে আমরা অভিযোগ দায়ের করতে পারছি না।যার ফলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।আবার, ধরুন আপনি কোন ফার্মেসি থেকে কোন ঔষধ ক্রয় করলেন,ক্রয় করার সময় লক্ষ্য করলেন যে ধার্য্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে আপনার কাছে ঔষধ বিক্রি করলো।আপনি বলার পরও ধার্য্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্য নিলো আপনার কাছ থেকে। এই মুহূর্তে আপনি কি করবেন?? আপনি কি প্রতারণার স্বীকার হয়ে ঠকে চলে আসবেন, নাকি অভিযোগ দায়ের করে এর প্রতিকার নিবেন।প্রতিকার পেতে হলে অবশ্যই আপনার এ আইনটি সম্পর্কে জ্ঞ্যান থাকতে হবে।ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ধারা (৪০) অনুযায়ী আপনি অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। ধারা -৪০ এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্যের অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনাধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।উক্ত আইনের মাধ্যমে আপনি যদি কোন অভিযোগ দায়ের করেন, এবং কতৃপক্ষ যদি অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায় তাহলে ওই বিক্রেতা শাস্তি ভোগ করবে। যার ফলে পরবর্তীতে হয়তো ওই বিক্রেতা আর নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করবে না।সেই সাথে আপনি আপনার অধিকার বুঝে পলেন এবং দেশের মানুষের জন্য অবদান রাখতে পারলেন। কার্যত আপনি অভিযোগের মাধ্যমে দেশপ্রেম এর নজির স্থাপন করলেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ -১৮ তে জনস্বাস্থ্যর কথা বলা হয়েছে।যেখানে, জণগনের পুষ্টির স্তর- উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন কে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করিবেন। এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করিবেন।অতএব, এটা বলাই যায় যে, আপনি অভিযোগের মাধ্যম শুধু আপনার নিজের অধিকার ই আদায় করলেন না বরং জনস্বাস্থ্যর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন।এখন আসি, অভিযোগ করলে আপনার কি লাভ হবে?? আমরা অনেকেই শুনেছি মামলা( অভিযোগ) করলে অর্থ খরচ হয়, কিন্তু মামলা করে অর্থ পাওয়া যায় এটা হয়তো অনেকেই জানেন না।কিন্তু ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ এমন একটি আইন যেখানে এ আইন অনুযায়ী কোন অভিযোগ দায়ের করলে তা যদি কতৃপক্ষের তদন্তে অভিযোগের সতত্য প্রমানিত হয় তাহলে যে পরিমান অর্থ জরিমানা আরোপ করা হবে অর্থাৎ আদায়কৃত জরিমানার ২৫% তাৎক্ষণিক ভাবে অভিযোগকারী কে প্রদান করা হবে।বাণিজ্যিক আইনের ভাষায় একটা মতবাদ আছে সেটা হলো “ক্রেতা সাবধান নীতি” অর্থাৎ আপনি একজন ক্রেতা বা ভোক্তা হিসাবে আপনাকেও সাবধান থাকতে হবে। কোন পণ্য না দেখে বা ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ না করে ক্রয় করা যাবে না।সর্বশেষে বলবো, মহামারি করোনা ভাইরাসে স্থবির পুরো বিশ্ব।ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করবো আপনেরা সততা আর নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করেন।সেই সাথে যথাযথ কতৃপক্ষের নিকট আহব্বান জানাবো, নিয়মিত বাজার তদারকি করার জন্য,সেই সাথে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক শাস্তির আয়তায় আনা। যাতে পরবর্তীতে কেউ যেনো ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত করতে না পারে।
মীর শুভ
শিক্ষার্থী : আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া