টাকা হলো দ্বিতীয় স্রষ্টা। টাকা থাকলে নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়। এই মহা পৃথিবীর বিশেষ কিছু জিনিস ছাড়া প্রায় সব কিছুই পাওয়া যায় টাকা থাকলে। টাকার এতই কদর! টাকা যার হাতে যায়, টাকা তারই কথা বলে। হাত বদল হওয়া মাত্রই, সে পর হয়ে যায়। যার হাতে থাকবে, সে তারই গুণগান গাইবে। একারণেই টাকা সকলের কাছেই অতি লোভনীয় একটা জিনিস। একটি পয়সা বা দুটি টাকার জন্য পৃথিবীর বুকে কত যে মারামারি এবং রক্তারক্তি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
গুণীজন বলেন, টাকার একটি অদৃশ্য গরম রয়েছে। গরম মানে উষ্ণতা আর কী। যাদের হাতে টাকার প্রাচুর্যতা রয়েছে, তাদের জীবনানুভূতি এবং যাদের টাকার প্রাচুর্যতা নেই তাদের জীবনানুভূতি এক নয়। অনেকেই খেয়াল-খুশি মত টাকা খরচ করছেন, কিছু কাজে লাগাচ্ছেন বাকিটা নষ্ট করছেন। আবার অনেকেই সামান্য কিছু টাকা বারংবার হিসেব করে খরচ করছেন। দুটি টাকা সেভ করার জন্য তারা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হাতে টাকা থাকলে আত্মবিশ্বাসই থাকে অন্যরকম। দৈনন্দিন জীবনের অনেক অনুভূতির মধ্যে চেঞ্জ আসতে থাকে তখন। আবার, হাতে টাকা না থাকলে টেনশনেই নাকি মানুষের ক্ষুধা বেড়ে যায়।
সময়ের ব্যবধানে কেউ অনেক টাকার মালিক হন, আবার কেউ বা অনেক ক্ষমতাবান হন, আবার কেউবা ক্ষমতা হারান। তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থাকলে আর্থিক নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে একজন ব্যক্তির।
যারা বংশীয় প্রভাবের কারণে কিংবা টাকার জোরে হঠাৎ করে নেতা বনে যান তারা রাষ্ট্রীয় টাকা খরচের সময় একজন মধ্যবিত্ত এবং গরীব মানুষের অনুভুতিগুলি নিয়ে কী একটু চিন্তা করেন? যারা ঘুষ নিয়ে চাকুরী দেন, তারা কি একটি মধ্যবিত্ত ও গরীব মা’য়ের স্বপ্নগুলির কথা একটিবারও অনুভব করতে পারেন? সন্তানকে ঘিরে একটি গরীব পিতার যে কত স্বপ্ন, কত আকাঙখা রয়েছে সেটি যদি চাকুরীদাতা ব্যক্তিবর্গ বুঝতে পারতেন তাহলে চাকুরী দেওয়ার জন্য কারও কাছ থেকে কখনও ঘুষ নিতেন না। ছেলে একটি চাকুরী পেলে একটি গরীব পরিবারের বাবা-মা যে কতটা খুশি হন, কতটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন সেটি ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। সন্তানের একটি ভাল জীবিকা হবে- এর জন্য শত সমস্যা ও কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নেন সকল বাবা-মা। যারা নেতা হয়ে যান। সরকারি নিয়োগে যারা জড়িত থাকেন তারা যদি এসব বাবা-মা’র স্বপ্নগুলির কথা যদি একটু ভাবতেন, একটু চিন্তা করতেন, তাহলে তারা কখনই চাকুরী নিয়ে অর্থ-বানিজ্য করতে পারতেন না।
অনেকেই নেতা হয়ে যাওয়ার পর ভাবেন, সরকারি টাকা ও সুযোগ-সুবিধা পথে কুড়িয়ে পাওয়া ভোগের বস্তু। কিছু খেলাম, কিছু ছিটালাম, আর বাকি নিজস্ব লোকদের মধ্যে বরাদ্দ দিলাম। সরকারি টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে নেতারা যদি মধ্যবিত্ত ও গরীবদের আবেগ ও স্বপ্ন নিয়ে একটু চিন্তা করতেন তাহলে প্রতিটি টাকাই সাবধানতার সাথেই খরচ করা সম্ভব হতো।
একজন গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষ তার সীমিত টাকা যে অনুভুতি ও চিন্তা মাথায় নিয়ে খরচ করেন, রাষ্ট্রীয় তহবিলের প্রতিটি টাকা ঠিক সেই অনুভূতি নিয়েই খরচ করা উচিত। কারণ, এই টাকাগুলো এই গরীব মানুষ এবং কিছু বিত্তশালী মনুষদের পকেট থেকে কখনও দেখিয়ে কিংবা কখনও না দেখিয়ে কেটে নেওয়া হয়। তারা নেতৃত্ব নির্বাচন করেন এই বিশ্বাসে যে, নেতৃবৃন্দও তাদের মত চিন্তা-ভাবনা করে রাষ্ট্রের প্রতিটি টাকা খরচ করবেন। দুটি টাকা হলেও সেভ করার চেষ্টা করবেন।
‘যেভাবে খুশি খরচ করব, যেভাবে খুশি বিলি-বন্টন করব’- এরূপ চিন্তাভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে৷ জনগণ নেতৃবৃন্দদের উপর অনেক প্রত্যাশা রাখেন। তারা ভাবেন নেতৃবৃন্দ তাদেরই একজন। তারা ভাবেন, নেতৃবৃন্দ তাদের মত করেই সরকারি টাকা খরচ করবেন এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্টন করবেন। কিন্তু অচিরেই জনগণ বুঝতে পারে, তারা যাদেরকে অনেক আশা নিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন, তাদের সাথে জনগণের স্বপ্ন ও চিন্তা-ভাবনার রয়েছে বেশ ফারাক। জনগণ চান এক আর নেতাগণ করে বসেন আরেক। নেতারা যদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দশটি টাকাও খরচ করতে চান, খরচের আগে একটি গরীব বাবা হলে কিভাবে সেটি তার পরিবারের জন্য খরচ করতেন বা তার সন্তানদের মধ্যে বন্টন করতেন- নেতাদেরও ঠিক সেভাবেই খরচ করা উচিত।
একটি গরীব বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দুটি টাকা খরচ করার আগে কয়েকবার ভেবে নেয় কিভাবে খরচ করলে সে তার টাকাটির সর্বোচ্চ উপযোগিতা পাবে। অন্যের টাকা বলে যাচ্ছেতাই ভাবে খরচ করা উচিত নয়। নিজের টাকা হলে কী আমরা যাচ্চেতাই ভাবে খরচ করতে পারতাম? নিজেদের টাকা খরচ করার আগে আমরা অনুধাবন করতে পারি, কত কষ্ট করে টাকাগুলো আমরা আয় করেছিলাম। সরকারি তহবিলের টাকা খরচ করার সময় একজন মধ্যবিত্ত পিতা-মাতার অনুভূতিগুলি মাথায় রাখলে রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব বলেই আমার মনে হয়।
–রায়হান কাওসার, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। Email: raihankawsardu@gmail