একজন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হবার জন্য বই পড়াই যথেষ্ট। আর এসব বইয়ের তালিকায় বিদেশী বইয়ের তালিকার প্রাধান্য থাকে অনেকের কাছেই। বিদেশী সিনেমা বা গানও অনেক রাজনীতিবীদদের কাছে কদর পায়। রাজনীতিবিদদের ভিতর অন্য দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যপক চর্চার ফলে দেশীয় চিন্তা ও কাজে বিশেষ গলদ আসে। এমন কাজগুলো রাজনীতিবীদকে বাংলাদেশীদের মন বুঝতে ও সে অনুযায়ী কাজ করে একতা তৈরী করতে বাধার তৈরী করে। কেন একজন কৃষক সারাদিনের কাজ শেষে আইটেম গান শুনে, মান্না, সাকিব খান বা সালমান শাহ-এর সিনেমা দেখে তা বুঝার জন্য বাংলা সিনেমা দেখার প্রয়োজনীয়তা অস্বিকার করা যায় না। তাদের মত করে তাদের কথা বলার জন্য তাদের রুচির সাথে সখ্যতা থাকতে হবে। এই সখ্যতা একতা তৈরীর জন্য প্রয়োজন। সংস্কৃতির সুস্থতা ছাড়া রাজনীতির সুস্থতা লাভ করা দূরহ বলা যায়।
বাংলাদেশী সিনেমার জগতে সিনেমা হল, সিনেমা নায়ক ও দর্শক খড়া চলছে। ১৪০০+ সিনেমা হল থেকে বর্তমানে ৩০০ মত সিনেমা হল বিভিন্ন সময় চালু থাকে। সময় নিউজের টিভির এক প্রতিবেদনে দেখা যায় বর্তমানে চালু হলের সংখ্যা ৬০( https://www.somoynews.tv/pages/details/199290 ) । বিষয়টি শুধু সিনেমার সাথেই সংশ্লিষ্ট নয় সংস্কৃতির সাথেও জড়িত। এমন চলতে থাকলে তা দেশের প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর।অন্য দেশের সিনেমা প্রীতি দেশের ভেতর বিশেষ খড়া তৈরী করবে। এখন অনেকেই বাংলাদেশের সিনেমা ইউটিউব বা পাইরেসি ভিডিও দেখে সমালোচনা করে অনেকে দেখেই না। যদি সিনেমা হলে সিনেমা দেখে সমালোচনা করা হয় তাহলে দর্শক খড়া কাটলে সিনেমা, সিনেমার গল্প বা নায়ক ও নায়িকা সংকট দ্রুত কাটবে। । বাংলা সিনেমা ধ্বংস করার জন্য মাঝখানে কিছু অশ্লিল সিনেমা কুপ্রভাব ফেলেছিলো। আর এখন আধুনিক হতে গিয়ে নিজে দেশের সিনেমা না দেখে সেই আগুনে আরো পেট্রেোল ঢেলে দেয়া হচ্ছে।
বাংলদেশী নাটক খুবই জনপ্রিয়। এই সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও কিছু দূর্বলতা দেখা যাচ্ছে। এখন ওয়েব সিরিজের নামে যা তৈরী হচ্ছে তা একসময় বাংলাদেশের নাটক শিল্প নষ্ট করতেও ভূমিকা রাখবে এমন মন্তব্য করা অমূলক নয়। গতানুগতিক ধারার গল্পও বিদেশী নাটকের প্রতি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ঝোক এই সমস্যা বৃদ্ধিতে আরো জ্বালানি জোগাচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংস্কৃতির নিজস্বতা নষ্ট হতে আর বেশী সময় লাগবে না। নাটকের ক্ষেত্রেও একজন বাংলাদেশের সক্রিয়তা ধরে রাখা প্রয়োজন।
গান বা সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর বিরুপ প্রভাব আছে। এক টিচারকে প্রশ্ন করেছিলাম। বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য পোষাককে অনেকেই দায়ী করেন সে বিষয়ে তার মন্তব্য কি। তিনি বললেন, বাংলাদেশী সংস্কৃতির সাথে সে পোষাক গুলো যায় কিনা সেটাও তো দেখতে হবে। অন্ধ অনুকরণের মত যদি আমরা অন্যকে অনুসরণ করি তারা কোন আর্থ-সামাজিক অবস্থায় গিয়ে সেটা করছে সে সমন্ধে যদি জ্ঞান না থাকে তা তো ভয়ংকর হতেই পারে। আগে তো নিজস্ব পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে। সবার ভিতর সঠিক শিক্ষা ও মানসিক উন্নতি সাধন না করে যদি শুধু প্রগতিশীলতা দোহাই দেই তবে তা সমস্যা তৈরী করতে পারে।
বিদেশী সিনেমায় একদল যুবক বার ও নাইট ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। অনেকেই এদের হিপ্পি বলে থাকে। অনেকেই বুঝে না বুঝে তাদের অনুসরণ করছি। এদের দ্বারা খারাপ ভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে একরকম পাশ কাটানো হচ্ছে যা সংস্কৃতির জন্য খুবই ভয়ংকর। কাজের প্রতি মূল্যবোধ ও নিজের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি না করে ঢালাও ভাবে অন্যের বিলাসিতা বা সংস্কৃতি অনুসরণ করা কতটা ভয়ংকর তা কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি ও আরো পাবো।
বাংলাদেশে নিখিল নামে কৃষককে মারলেও তেমন কোন প্রতিবাদ হয় না বরং কোন দেশে কৃষ্ণাজ্ঞ মারা গেল তা নিয়ে ব্যপক সচেতনতা দেখানো হয়। হাতির মৃত্যু নিয়েও অনেকই মানবিক প্রমাণ করার চেষ্টা করে কিন্তু এদেশে সাংবাদিকের মৃত্যু হলে, অত্যাচারিত হলে কোন মেয়ে, ন্যায্যতা না থাকলে কৃষক ও শ্রমিকের শ্রমে কোন প্রতিবাদ করে মানবিক হবার তেমন কোন চেষ্টা করি না। আর এসব নিয়ে কেউ কাজ করলেও তার পাশে থেকে সাড়া দেবার একতা নাই। সাংস্কৃতিক সম্বনয়হীনতা রাজনৈতিক সম্বনয়হীনতা তৈরী করেছে।
সংস্কৃতির একতা না থাকলে দাবীর জায়গায় ও অধিকারের জায়গায় একতা আসা খুবই মুসকিল। সংস্কৃতি বাচাতে হবে এটি এখন রাজনীতির অন্যতম অংশ হওয়া উচিত। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিস্তর কাজ করতে হবে। এই আগ্রাসন বন্ধ করতে না পারলে জাতিকে আরো ভুগতে হবে। এক বা একাধিক প্রজন্ম যদি বাংলা গান, সিনেমা, নাটক বা সংস্কৃতির প্রতি বিমুখ হয় তাহলে জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরা খুব অস্বাভাবিক নয়। সাকিব খানের সিনেমা দেখা যদি অরুচির পরিচয় হয়, মনির খানের গান শোনা যদি কারো কাছে অপমানের হয় তাহলে এর দায়ভার জাতি এড়াতে পারবে না ও পারছেও না।
বাংলাদেশে নতুন এক অপসংস্কৃতি সংস্কৃতি হিসেবে চালু হয়েছে। আমি রাজনীতি ঘৃণা করি এই চিন্তা অনেকেই গর্বের মনে করে। বিধবা ভাতার কার্ড কিনতেও যে টাকা দেয়, যে সরকারী হাসপাতালে গিয়ে সুবিধা না পেয়ে আফসোস করে বা লোড শেডিং নিয়ে বিরক্ত হয় সেও রাজনীতি ঘৃণা করে আরো কত কিছু যে ঘৃণা করে তার ইয়াত্তা নাই। দায় চাপানোর অপস্কৃতি জনগণের মাঝে বিনোদনে আরো বেশী আকৃষ্ট করে। এই বিনোদন কাজ থেকে দূরে রাখে ও কর্তব্য জ্ঞান শিথিল করে। এই সংস্কৃতিতে সমস্যা হলো সুস্থতা নির্বাচনে যা মনকেও অসুস্থ করতে পারে।
ভালো লাগলেও গান শুনতে মন চায় আবার খারাপ লাগলেও গান শুনতে মন চায়। অনেকেই ভালো খারাপ যাই লাগুক না কেন গান শুনে, ইউটিউব দেখে,ফেসবুক চালায় বা অন্যকোন বিনোদন মাধ্যমে সময় কাটায়। জ্ঞান অর্জনের যে আগ্রহ তা আর নেই। বিনোদন নির্ভর যে মনমানসিকতা তৈরী হচ্ছে তা তা অগ্রগতির পথে বাধা। বিনোদন মুখী সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে মুক্তি ঘটবে না।
মনো জাগতিক উপনিবেশ সমন্ধে যদি উপলব্ধিগুলো ভোতা হয় তাহলে অন্য দেশে তারকা মারা গেলে তা নিয়ে সবাই কান্না করবে কিন্তু এদেশে একজন মেয় ধর্ষণ হলে, ত্রাণের চাল চুরি হলে, কৃষক ঋণে পড়ে আত্মহত্যা করলে, বাজারে ভেজাল পণ্য বিক্রি হলে, মানুষের ভালো করতে গিয়ে কোন ব্যাক্তি সমস্যায় পড়লে তার নিয়ে কথা বলার মত কাজ করার মত লোক পাওয়া যাবে না। নিজের সংস্কৃতিতে বিশস্ততা ছাড়া জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা বেশ মুসকিল। নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসা ছাড়া দেশপ্রেমিক হয়ে উঠাও সম্ভব না। নিজেকে আন্তর্জাতিকীকরণ করবেন আর দেশের সংস্কৃতির সাথে বাস্তব যোগাযোগ থাকেবে ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য তাহলে দেশপ্রেমের সুফল আসা সম্ভব না।
একটা সময় খেলার মাঠে নেতৃত্বের গুণাবলী বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পারস্পারিক বন্ধুত্ব সামজিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখতো। প্রয়োজন এখন শিশু কিশোদের বিলাসিতার কাছে হার মেনেছে। খেলার মাঠের সামাজিকতা বা বইয়ের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে অনুৎপাদনশীল আয় খাতে নিজেকে নিযুক্ত রেখে নিজের ভবিষ্যত সহ দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার করতে কুপ্রভাব রেখে চলছে। এই সংস্কৃতির পরিবরতন ও তার প্রভাব নিয়ে কাজ না করলে জাতি অনেক বড় বিপদে ।
মানুষের ভেতর আর বাইরের সম্বনয়ে গঠিত সংস্কৃতি প্রতিনিধিত্ব করে তার স্বপ্ন সম্ভাবনা আর সাফল্যের সত্যতা সবার সামনে আনতে। মানুষকে অধ্যয়ন করতে ও তার সমন্ধে জেনে তার আপনার হতে সংস্কৃতি প্রথম ভুমিকা পালন করে। সাংস্কৃতিক বিভেদ দেখা দিলে বা অপস্কৃতি তৈরী হলে জাতিগত অনৈক্য আশা অস্বাভাবিক নয়। সাংস্কৃতিক নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণেই নিখিল হত্যা নিয়ে আন্দোলন হয় না কিন্তু একটি হাতি মরা নিয়েও নানা আবেগি আর মানবিক কথা প্রচার হয়। এখন মানবিক কাজগুলো মানুষ হিসেবে করতেই হবে কিন্তু পাশ কাটিয়ৈ কোন কাজ ভালো কাজ নাও হতে পারে। এই মুহূর্তে মানুষের ভেতর একতা তৈরী করার জন্য সাংস্কৃতির পরিবর্তন ও তা নিয়ে রাজনীতিবীদদের ব্যাপক কাজ করা দরকার। এই কাজ করতে গেলে এমন কিছু কাজ হবে যা দ্বারা প্রত্যাশিত কাজের সাফল্য আর সম্ভাবনা পাওয়া সম্ভব।
লেখকঃ নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
mdnurunnobiislam379@gmail.com