নূরুন্নবী সবুজ
রাজনৈতিক দল যখন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের মাঝে পার্থক্য করতে পারেনা তখন সামাজিক মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান পরাধীনের মত হয়ে উঠে।রাষ্ট্র এবং সরকার তখন আলাদাভাবে ধরা না দিয়ে সরকার নিজেকেই রাষ্ট্র ভাবতে শুরু করে এবং তা আচরণেই প্রকাশ পায়।রাষ্ট্র এবং সরকারের ধারণা স্পষ্ট না করা পর্যন্ত জনগন নিজেকে নিজের সম্মানের,অধিকার আর কর্তব্যের বিষয়ে দৃঢ় করতে পারবে না আর তার ফলে রাজনীতিতে ক্ষমতার বদল হলেও জনগণ জনকল্যাণ মূলক কোন কাজ পাবে না বা অন্যভাবে বললে তারা শোষিত হতেই থাকবে।আর এক্ষেত্রে যারা কাজ করতে পারে বা অকাজের মাধ্যমে জনজীবন বিষিয়ে তুলতে পারে তারা হলো রাজনীতিবীদ ও রাজনৈতিক সংগঠন।
একজন মানুষের জীবনে ইতিবাচক কথার গুরুত্ব আছে বলেই একজন হতাশগ্রস্ত মানুষকে ভালো কথা দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে সুপথে আনা যায়। একজন মানুষ যান্ত্রিক হয়ে যায় যদি তার জীবনে প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু না থাকে ।তার পক্ষেই আত্মহত্যা করা সহজ যে বিশ্বাস করে তাকে কেউ ভালোবাসে না বা তার ভালো কিছু করার মত শক্তি নাই বা সে যে ভুল করেছে তার কোন সমাধান নাই।ব্যক্তি ভালোবাসা যেমন শুধু ব্যক্তিই নয় সমাজকে সুন্দর করে তেমনি রাজনৈতিক জ্ঞান আর ভালোবাসা একটি নিরাপদ জীবন দেয় যা যে কোন সমাজকে মজবুত করার ক্ষমতা রাখে। শ্রমিকদের দ্বায়িত্ব যেমন উৎপাদন করা তেমনি রাজনীতিবীদদের দ্বায়িত্ব জনগণকে সচেতন করা আর তারা এই কাজকে ভুলে যাচ্ছে বলেই সাধারণের অবস্থা আরো করুণ হচ্ছে।
রাজনীতিবীদদের কাজ হচ্ছে জগণের সাথে কাজ করা তাদের সচেতন করা ও তার অধিকার কর্তব্য বুঝিয়ে তা প্রাপ্তির জন্য প্রতিবাদী করা। রাজনীতিবীদের যদি জনগণের সাথে সম্পর্ক না থাকে তাদেরকে একত্রে করে মাঠে নামতে না পারে তাহলে তা রাজনীতিবীদদের ব্যর্থতা। কিন্তু এটা আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই লজ্জার বিষয় যে আমরা জনগণকে সচেতন না করে শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাবার জন্য ন্যায় বা অন্যায় যে কোন পথ অবলম্বন করতে পারি।
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত,তাদের ভেতর নেই সঠিক রাজনৈতিক সচেতনতা এই অযুহাতে অনেক রাজনৈতিক সংগঠন তাদের কাজের দূর্বলতাকে ঢেকে রাখতে চায়।আবার কেউ এই সুযোগে ক্ষমতাই গিয়ে খুব সহজে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফেলে। সাধারন জনগণের জন্য কিছু করতে চাইলে তাদের যে অবস্থান সেই অবস্থান সমন্ধে পরিস্কার ধারনা থাকতে হবে এবং সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে তার বিস্তারিত আবিস্কার করতে হবে। আমরা জনগনের সাথে না মিশে ক্ষমতার সাথে মিশি বলেই ক্ষমতার বদল হলেও জনগণের ভাগ্যের বদল হয় না।
কোন রাজনৈতিক দল যদি জনগণকে সঠিক রাজনৈতিক জ্ঞান বা সচেতনতা তৈরীর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা ক্ষমতায় এসে আর তার অপব্যবহার করতে পারবে না এমন ভয় হয়ত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আছে আর তাই তারা কর্তব্যে ভুলে ভুল কাজ করে বা ভুল পথে হাটে। সামাজিক সংগঠন সাধারনত সামাজিক সমস্যাগুলোতে মানববন্ধন এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কিছুু বড় ধরণের কাজও করে থাকে।তারা সমাজের মানুষ যেন বড় ধরনের সমস্যায় না পড়ে তার জন্য ছোট ছোট সমাধান করে থাকে।
সামাজিক সংগঠন মুলত সমাজের দৃশ্যমান সমস্যা নিয়ে কাজ করে।কিন্তু রাজনৈতিক দলের কাজ দৃশ্য অদৃশ্য যে কোন সমস্যায়। রাজনৈতিক দল সমাজের সমস্যা আর সম্ভাবনার চেয়ে ব্যাক্তি সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে তার স্থায়ী সমাধানের পথ আবিস্কার করে ও সে পথে হাটে।আর তাই সামাজিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠনের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য জরুরী । রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যত তাড়াতাড়ি এই সত্য বুঝতে ও বাস্তবায়ন করতে পারবে তত তাড়াতাড়ি দেশের ও দশের মঙ্গল হবে। রাজনৈতিক দলের কাজ ক্ষমতাই গিয়ে সব কিছু পরিবর্তন করা নয় বরং সব কিছু পরিবর্তন করে নিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন করা।
জনগণের সাথে যত বেশী আত্মীক সম্পর্ক তৈরী হবে,তাদের আস্তা যত অর্জন করা যাবে সবচেয়ে বড় কথা তাদের গুরুত্ব যখন তাদের বুঝানো যাবে তখনই একটি রাজনৈতিক দলের সফলতা।ডানপন্থী বা বামপন্থী যে ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনই হোক না কেন তার যদি জনসর্ম্পকতা না থাকে তাহলে সে সংগঠনের কাজে বা উদ্দেশ্যে কিছু গলদ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
রাজনীতিক বলতে বুঝায় সহজ ও কার্যকরী বিশ্লেষণে অধিকার ও কর্তব্য সচেতনতার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাওয়ার জ্ঞান এবং চর্চা।যখন একজন কৃষক ফসল উৎপাদন করছে আরো ফসল উৎপাদন করার জন্য শ্রম ও অর্থ দিচ্ছে তখন সে সচেতন ভাবেই হোক বা অচেতনভাবেই হোক দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। একজন রিক্সা,ভ্যান,বাস বা অন্য কোন চালকবা কোন পরিবহন শ্রমিকের শ্রম,তেরী পোষাক খাতের শ্রমিকের মেহনত ছাড়াও সকল মানুষের নিজের জন্য কোন দ্রব্যের উপযোগ তৈরী করলে তা দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করছে।
সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ নিজের জন্য বা নিজের পরিবারের জন্য কিছু না কিছু কাজ করে থাকে তার গুরুত্বও খাটো করে দেখার সুযোগ নাই।একজন শিক্ষক যখন তার ছাত্রকে কল্পনার জগৎ প্রসারিত করার সাথে সাথে বাস্তবে কি কি পদক্ষেপ নিতে হয় তা শিক্ষা দিচ্ছে বা একজন গবেষক যখন সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানের জন্য শ্রম দিচ্ছে বা সম্ভাবনাময় দিকগুলো তুলে ধরছে তখন তা সমাজের ভিতর ভারসামাস্য তৈরী করছে কিন্তু চূড়ান্ত ভারসাম্য তৈরীতে যে স্বত্ত্বা কাজ করে তা হলো রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পূর্ণ মানুষ।কোন ভাবেই আমরা রাজনীতি বা রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে থেকে দেশের জন্য দশের জন্য স্থায়ী কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারবো না।
রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তাই নতুন সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হবে নতুন কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে সামনের দিকে আগাতে হবে।যে কাজ গুলো আমি শুধুমাত্র আমার জন্য বা আমার পরিবারের জন্য করছি সে কাজগুলো যদি আমরা দেশ এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য করি তাহলে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। সমাজে কর্মের মূল্যবোধ তৈরীর জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন জরুরী কিন্তু রাজনীতির জ্ঞান এবং চর্চায় যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।আর এজন্য রাজনৈতিক সংগঠনকে আগে আরো দেশপ্রেমিক,কর্মঠ এবং সৃষ্টিশীল হতে হবে ।তারা যদি শুধুই ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন দেখে তাদের কর্তব্য কাজ ভুলে যায় তাহলে তা পুরো জাতির জন্যই ক্ষতিকর।আর আমরা হয়ত এই ক্ষতির মাঝেই আছি আর তাই আমরা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই সবাই ক্ষমতায় গিয়ে পরিবর্তনের কথা বলছে কিন্তু পরিবর্তন করে ক্ষমতায় যাচ্ছে না।
একজন মানুষের খাদ্য,বস্ত্র,চিকিৎসা,শিক্ষার পাশাপাশি আরো কিছু মানবাধিকার নিশ্চিত করা দরকার।কেউ যদি নিজেকে বিকাশ করার সুযোগ না পায় তাহলে সে কিভাবে তার সেরাটা দিবে। একজন মানুষের কাছ থেকে তার কাজের সেরাটা নেবার জন্য অবশ্যই তাকে সুযোগ দিতে হবে তার মাঝে উৎসাহ ধরে রাখার জন্য তার একঘেয়েমি দূর করার জন্য তার সাথে ভালোবাসার আর বিশ্বাসের বন্ধন তৈরী করতে হবে। একজন ব্যক্তি তার দেশ গড়ায় দেশের কাঠামো পরিবর্তনে তারও যে ব্যাপক ভূমিকা আছে এ উপলব্ধি তার ভিতর আনতে হবে ।
প্রত্যেক মানুষের ভিতর নিজের প্রতি তার মূল্যবোধ তৈরী করতে হবে। কোন মানুষ বা জাতির ভেতর যে দূর্দিন সে সময়ে পাশে থেকে যদি তাদের নিয়ে তাদের জন্য কাজ করা যায় তাহলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন আসবে তেমন ইতিবাচক ছোয়া লাগবে দেশের সকল ক্ষেত্রে আর এই কাজটি করবে একটি প্রকৃত রাজনৈতিক সংগঠনকে। কোন রাজনৈতিক সংগঠন যদি এই কাজটি না করে তাহলে জাতির পরিবর্তন হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের কর্ম পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা জরুরী।তারা যদি তাদের শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাবার উদ্দেশ্যকে বাতিল করে জনগণের জন্য জনগণের সাথে মিশতে পারে তাহলে বাঙ্গালী জাতির প্রত্যাশিত ইতিবাচক পরিবর্তন আসবেই আসবে।
সর্বশেষ একটা গল্প না বললেই নয়। কোন এক গ্রামে এক নাপিত ছিলো।সে মানুষের চুল কাটতে কাটতে ঘটনাক্রমে কোন এক ব্যক্তির ফোড়া কাটে এবং অসুস্থ ব্যক্তিটিও ঘটনাচক্রে সুস্থ হয়ে যায়। গুজব ছড়ানোর মততার সুনাম ছড়িয়ে পড়লে প্রকৃত ডাক্তারদের কাছে না গিয়ে লোকজন কম ঝামেলায় সুস্থ হবার জন্য সেই নাপিতের কাছে যাওয়া শুরু করলো।ডাক্তারদের আয় কমে যাওয়া শুরু হলে সব ডাক্তার একত্রে বসে নাপিতকে একটু পড়াশুনা করনোর উদ্যোগ নিলো।নাপিতকে চিকিৎসা বিজ্ঞান সমন্ধে শিক্ষা দেবার পর যখন সে কারো ফোড়া কাটতে যায় তখন তার ভয় লাগে এই জায়গায় তো এই রগ বা শিরা উপশিরা থাকে যা কাটা পড়লে তার মৃত্যু হতে পারে তখন সে আর ফোড়া কাটতে পারে না। এমন অবস্থায় একসময় নাপিত তার পুরানো পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য হয় আর ডাক্তাররা তাদের সেবা চালিয়ে যেতে থাকে।
বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষের মাঝে রাজনৈতিক জ্ঞান সৃষ্টির জন্য কাজ করা দরকার। রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনের পার্থক্য আরো স্পষ্ট হওয়া দরকার।শুধু ক্ষমতায় যাওয়াই নয় বরং মানুষের মাঝে থেকে মানুষের জন্য কাজ করে তাদের ভেতর রাজনৈতিক জ্ঞান তৈরী করে তাদের সেবক হবার কার্যকরী কর্ম পরিকল্পনাই হোক একটি রাজনৈতিক সংগঠনের কাজ।
নুরন্নবী সবুজ, আ্ইন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কলামিষ্ট,ইমেইলঃmdnurunnobiislam379@gmail.com
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত……