দেশে আইনজীবীর সংখ্যা কত? প্রয়োজনের তুলনায় আইনজীবীর সংখ্যা কম নাকি বেশি? এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক হতে দেখা যায়। অধিকাংশ মানুষেরই উপরের এই বিষয় গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারনা নেই, আইনজীবীরাও এর বাইরে নয়। এক্ষেত্রে আমরা যদি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কতৃর্ক সর্বশেষ ২০১৮ সালের ভোটার তালিকা দেখি তাহলে দেখা যায় বার কাউন্সিলের মোট ভোটারের সংখ্যা ছিলো ৪৩৮৮৪ জন। অর্থাৎ, ২০১৮ এর মে পর্যন্ত বার কাউন্সিলের মোট আইনজীবীর সংখ্যা ৪৩৮৮৪ জন। সেই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর নতুন করে তালিকাভুক্ত হয় ৭৭৩২ জন আইনজীবী। যেহেতু প্রায় দীর্ঘ তিন বছর কোনো এনরোলমেন্ট পরীক্ষা হয়নি সেক্ষেত্রে উপরের দুটি সংখ্যা যোগ করলে দাঁড়ায় ৫১৬১৬ জন আইনজীবী ( এই তিন বছরে যেসব আইনজীবী মারা গেছেন সেই হিসাব এখানে বিবেচনা করা হয়নি)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ৫১৬১৬ জন আইনজীবীর সকলেই কি প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার? উত্তর হচ্ছে না , এদের অর্ধেক বা তারও বেশি নন প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার। এই বিষয়ে ধারণা নেওয়ার জন্য ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে কতজন আইনজীবী প্র্যাকটিসে আছেন সেটি দেখতে পারি। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে তালিকাভুক্ত আইনজীবী আছেন ২৬ হাজারেরও বেশি। কিন্তু প্র্যাকটিস করেন ১০ হাজারেরও কম। ঢাকা আইনজীবী সমিতির প্রতি বছরের নির্বাচনের চিত্র থেকে এমনই অনুমান করা যায়। এটি একটি আইনজীবী সমিতির চিত্র, দেশের বাকি ৮০টি আইনজীবী সমিতির চিত্রও প্রায় একই। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে এই বিপুল সংখ্যক নন প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ারদের তালিকাটি করা হয়নি। যারফলে প্রকৃত প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার এর সংখ্যা আমাদের কারোরই জানা নেই। অনুমান করে বলা যায় সারাদেশে প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার এর সংখ্যা ২৫ হাজারের মধ্যে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুযায়ী প্র্যাকটিসনার আইনজীবীর এই সংখ্যা কি যথেষ্ট ? গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে আইনমন্ত্রী জানান ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিলো ৩৬ লাখ ৪০ হাজার। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির উপরে। এই বিপুল জনসংখ্যা ও মামলা নিষ্পত্তির জন্য ২৫ হাজার প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার কখনো কি পর্যাপ্ত হতে পারে?
এছাড়াও আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাই প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৪ সালে দেশে চলমান মামলার সংখ্যা ছিলো ২৮ লক্ষ, গত পাঁচ বছরে দেশে মামলার সংখ্যা সাড়ে আট লাখ বেড়ে হয়েছে ৩৬ লক্ষ ৪০ হাজার। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিলো ১৪ কোটি ৯৭ লক্ষ, আজ ২০২০ সালে এই জনসংখ্যা ধরা হয় ১৭ কোটির বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে প্রতিবছর জন্যসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে সেই অনুপাতে কি আইনজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত ২০১৫ সালের ভোটার তালিকা অনুসারে আইনজীবীর সংখ্যা ছিলো ৪৮৪৬৫ জন এবং ২০১৮ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী আইনজীবীর সংখ্যা হয় ৪৩৮৮৪ জন। এখানে প্র্যাকটিসনার ও নন প্র্যাকটিসনার উভয় ধরনের আইনজীবীকেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নন প্র্যাকটিসনার আইনজীবীদের তালিকাভুক্ত না করলে এর সংখ্যা হতো অনেক কম। এই থেকেই দেখা যাচ্ছে নন প্র্যাকটিসনার আইনজীবী বাদ না দিয়েও জনসংখ্যা এবং মামলার সংখ্যার ন্যায় আইনজীবী বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বরং উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের পর প্রায় দীর্ঘ তিনবছর আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা বন্ধ ছিলো।
এরই মধ্যে গত অর্ধ যুগ যাবৎ এনরোলমেন্ট পরীক্ষার আগে ও পরে আন্দোলন করার যে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে তা যেনো নিয়ম বা সংস্কৃতিতে পরিণত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যদি বিষয়টি শেষ পর্যন্ত নিয়ম বা সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায় তাহলে সেটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, আইনজীবী সমাজ ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের জন্য কখনোই মঙ্গল জনক কিছু হবে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল থেকে মামলা জট নিরসনের জন্য বিচারক বৃদ্ধির কথা বললেও মানুষের সেবা বৃদ্ধির জন্য আইনজীবী বৃদ্ধির কথা বলা হয় না। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে বিচারকের সংখ্যা কত হওয়া প্রয়োজন সেই বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেলেও আইনজীবীর সংখ্যা কত হওয়া প্রয়োজন সেই বিষয়ে কোনো ধারনাও পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি ঢাকা আইনজীবী সমিতি ডিজিটাল ওকালতনামা চালু করেছে এবং ওকালতনামা বিক্রয় থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আইনজীবীদের নিজস্ব তহবিলে জমা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বছর শেষে আইনজীবীরা এই অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, অন্যান্য বার সমিতি গুলোরও এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তাতে যেমন ওকালতনামা জালিয়াতি করার সুযোগ থাকবে না, পাশাপাশি আইনজীবীদের জন্য একটি তহবিলও গঠন হয়। এই কর্মকান্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বার সমিতি গুলো খুব সহজেই প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার এবং নন প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার চিহ্নিত করতে পারবে। বার কাউন্সিলও আইনজীবী সমিতি গুলো থেকে এই তালিকা সংগ্রহ করে সহজেই প্র্যাকটিসনার ল’ইয়ার এর প্রকৃত সংখ্যা জানতে পারবেন। এরকম উদ্যোগ আইনাঙ্গনের জন্য আশাব্যঞ্জক।
বার কাউন্সিলের আচরণবিধিতে বলা হয়েছে “আইনজীবী পেশা ‘মানি মেকিং ট্রেড নয় “। কথাটি সকল আইনজীবী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীর মনে রাখা উচিত। জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত আইনজীবী বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তি করা উচিত এবং আমরা জানি আইনজীবীদের মধ্য থেকেই উচ্চ আদালতের ৯০% বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই নবীন আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবশেষে বলবো শক্তিশালী বার কাউন্সিল ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে দক্ষ আইনজীবীর পাশাপাশি দক্ষ বিচারকেরও সংকট তৈরি হবে এবং আগামীতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
আইনুল ইসলাম বিশাল
শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা আইনজীবী সমিতি।