অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
ধরুন আপনি কোন দোকান বা রেস্টুরেন্ট থেকে একটি পানীয় কিনে অর্ধেক পরিমান পান করার সময় লক্ষ্য করলেন পানীয়ের ভিতরে একটি পঁচা শামুক। অস্বস্তিতে আপনার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলো এবং আপনি কিছুদিন হাসপাতালে থাকলেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনি হয়তো একবার ভাববেন- পুলিশের দ্বারস্ত হবেন আবার পরক্ষণেই হয়তো-বা ভাববেন অযথা ঝামেলায় না জড়াতে, আইন শৃংখলার বর্তমান পরিস্থিতি পরিস্থিতি ভেবে। কিন্তু এই ঘটনাটিই ঘটেছিল মে ডনাগুয়ের সঙ্গে; ১৯২৮ সাল, স্কটল্যান্ডে। তখন তিনি উৎপাদনকারী স্টিভেনসনের বিরুদ্ধে আর্থিক ক্ষতিপূরন দাবি করেন এবং ইংল্যান্ডের হাউজ অব লর্ডস টর্ট আইনের অন্যতম তত্ত্ব,যা হচ্ছে যত্নের সাধারন নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ডনাগুয়ের আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করেন।
টর্ট আইন বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা, যেখানে সাধারনত কোন নাগরিক বা কোন সরকারি-বেসরকারি সত্তার অন্যায় কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আদালত আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলা করার অনুমতি দেন। এই আইনের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার আগের অবস্থায় পুনরুদ্ধার করা। টর্ট একটি ল্যাটিন শব্দ,যার অর্থ হচ্ছে কোন ধরনের অন্যায় (ইচ্ছাকৃত বা অবহেলা জনিত) যার মাধ্যমে কেউ ক্ষতির শিকার হন। শারিরীক আক্রমণ, ভুয়া কারাবাস, মানসিক যন্ত্রণা, জালিয়াতি, উপদ্রপ, ছলনা, মানহানি, অবহেলামূলক দুর্ঘটনা ইত্যাদি অন্যায় গুলো সাধারণত টর্ট আইনের আওতায় পড়ে। এ ধরনের কর্মকান্ড নিত্যদিনই কোন- না-কোনভাবে বাংলাদেশের সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা টর্ট আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক ক্ষতিপূরনের দাবিদার। কিন্তু আইনী বিধান না থাকায় ক্ষতিপূরন দাবি করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের অন্যায় কর্মকান্ডগুলো মূলত মারাত্বক দুর্ঘটনা আইন,১৮৮৫; দন্ডবিধি ১৮৬০; সিভিল প্রসিডিউর কোড ১৯০৮; ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড ১৮৯৮; এবং বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে মামলা পরিচালিত হয়ে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এই আইন গুলোর মাধ্যমে প্রতিকার পেতে পারেন কিন্তু আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বহুল আলোচিত দুটি মামলায় টর্ট আইনের প্রয়োগ উল্লেখযোগ্য ছিল। প্রথমটি ছিল বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি বনাম রওশন আক্তার (মার্চ,২০০৩) যেখানে কোম্পানিটিকে ১.৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরন দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে,যার মৃত্যু হয়েছিল সেই কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান চালকের অসতর্কতা ও অবহেলা জনিত গাড়ি চালনার জন্য। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, যখন কোন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি কারো অসতর্কতা ও অবহেলা জনিত গাড়ি চালনার জন্য মৃত্যুবরন করে,তার সাজা হিসাবে অপরাধীর কারাবরণ করা ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। এটি হয়তো তাদের জন্য কিছূটা সান্ত্বনাদায়ক হতে পারে,কিন্তু তাদের ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। এক্ষেত্রে টর্ট আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান একটি কার্যকর ন্যায়ব্যবস্থা হতে পারে।
দ্বিতীয় রায়টি উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া হয় সিসিবি ফাউন্ডেশন বনাম বাংলাদেশ (ফেব্রুয়ারি,২০১৬) মামলায়। এখানে নিহত চার বছর বয়সী শিশু জিহাদের পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় দেওয়া হয়,যার মৃত্যু হয়েছিল একটি ১৬ ইঞ্চি সুরক্ষাবিহীন গর্তে পড়ে যাওয়ার কারনে। গর্তটি ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিত্যাক্ত। এই মামলায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রমানের জন্য টর্ট আইনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ প্রয়োগ করা হয়েছিল। একটি হলো রেস ইপসা লোকিউটার, যার অর্থ হচ্ছে ঘটনার সংঘটনটিই যথেষ্ট অবহেলার ইঙ্গিত এর জন্য। এই মতবাদটি এই অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছিল যে, যদি কোন গাফিলতির অভাব নাও থাকতো তবু ছেলেটি কেন পাইপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল তা ব্যাখ্যা করার মতো কিছু নেই। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছিল যে, গর্তটি সুরক্ষিত করতে অবহেলা ছিলা তবে ঠিকাদারদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত তা নাকোচ করে দিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিধি স্বরুপ দোষী সাব্যস্ত করেন। এই দুটি মামলার রায়ে টর্ট আইনের তত্ত্বগুলোর প্রয়োগ প্রশংসনীয় ছিল।
প্রথম মামলাটিতে বাংলাদেশী প্রেক্ষাপট অনুযায়ী,ব্যক্তিগত টর্ট আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হয়। ব্যক্তিগত টর্ট আইনটি কোন ব্যক্তির দ্বারা অপর কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত টর্ট আইনের আওতাভুক্ত অন্যায়গুলোর সংঘটনের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। দ্বিতীয় মামলাটিতে বাংলাদেশী প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ,সর্বজনীন বা সাংবিধানিক টর্ট আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হয়।সর্বজনীন বা সাংবিধানিক টর্ট আইন,আইন প্রয়োগকারী বা সরকারি সংস্থা কর্তৃক কারও বিরুদ্ধে সংঘটিত টর্ট আইনের আওতাভুক্ত অন্যায়গওলোর সংঘটনের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়াও ক্যাথরিন মাসুদ বনাম এমডি কাসেদ মিয়া এবং অন্যান্য (ডিসেম্বর,২০১৭) মামলায় বাস চালক দোষী কি দোষী নয় এই প্রশ্নের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছিল বাস মালিকগণ প্রতিনিধি স্বরুপ দোষী হবেন কি না,যা টর্ট আইনের অন্যতম তত্ত্ব্ এই মামলায় উভয় পক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আদালত নিশ্চিত হন যে চালকের কোন বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না এবং বাসটির কোন ফিটনেস প্রসংসাপত্রও ছিল না। আদালত আরও নিশ্চিত হন যে মালিকগণ বাসের ফিটনেস প্রশংসাপত্র এবং চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স এর অভাব সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। অতএব তাদের প্রতিনিধিস্বরুপ দায়বদ্ধ করা সম্ভব।
এইসব মামলায় টর্ট আইনের প্রয়োগ থাকলেও বেশরিভাগ মামলায় দীর্ঘসুত্রতা ও আইনি জটিলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যেমন কঠিন হয়ে পড়ে তেমনি ক্ষতিপূরণ আদায় করাও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে যদি একটি বিধিবদ্ধ টর্ট আইন বিদ্যমান থাকতো,তাহলে প্রক্রিয়াটি আরও মসৃণ হতো। টর্ট আইনের আওতাভুক্ত অন্যায়গুলোর সংজ্ঞায়িতকরণ, নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতকরণ এবং আদালত পদ্ধতি সংজ্ঞায়নকরণ ইত্যাদি কারনে টর্ট আইন বাংলাদেশে কার্যকর করার এখনই সময়।
প্রতিদিনই বাংলাদেশে আমরা টর্ট আইনের আওতায় পড়ে এমন অন্যায় গুলো সংঘটিত হতে দেখি। এর কারণে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন অথবা আহত বা মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন তারা বেশীর ভাগই দরিদ্র্ টর্ট আইন শোকসন্তপ্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে এবং শুধু তা-ই নয় তাদের ন্যায় বিচারের আশ্বাস প্রদান করতে পারে।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, কলামিস্ট ও আইনজীবী, জজকোর্ট মেহেরপুর, mizanmpur06@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৯-৪৭৭ ৫৫২
তথ্যসূত্রঃ
১.বাংলা পিডিয়া,ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ
২. ডেইলি স্টার,১৮ নভেম্বর ২০১৯
৩. বাংলাদেশ ল‘ ডাইজেস্ট,২৩ মে ২০১৮