সব
facebook apsnews24.com
নিখিল তালুকদার যেনো আমাদের জর্জ ফ্লয়েড - APSNews24.Com

নিখিল তালুকদার যেনো আমাদের জর্জ ফ্লয়েড

নিখিল তালুকদার যেনো আমাদের জর্জ ফ্লয়েড

অঞ্জন রানা গোস্বামী

রামশীল গ্রামের নাম আমি অনেক শুনেছি। যাওয়া হয়নি কখনো। তবে শুনেছি। বোধকরি আমাদের কাছে পিঠের গ্রাম। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া আমাদের রাজৈরের একদম গা-ঘেঁষা উপজেলা। নাম শোনাটাই স্বাভাবিক। তবে রামশীল এমন একটা ঘটনায় যে জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হবে তা ভাবিনি!!

রামশীল বাজারের ব্রিজের ওপর চারজন লোক তাস খেলছিলেন। তখন স্থানীয় পুলিশের এএসআই তাঁর সোর্সকে নিয়ে একটি ভ্যানে আসলেন। এসে গোপনে মোবাইলে ভিডিও করতে লাগলেন। তাস খেলুড়েরা বুঝতে পারলো পুলিশ ভিডিও করছে। তাঁরা দৌড়ে পালিয়ে গেলো। একজন পালাতে পারে না। তিনি নিখিল তালুকদার। নিখিলকে মেরুদন্ডে আর মাথার পেছনে এএসআই হাঁটু আর কনুই দিয়ে আঘাত করেন। এরপর আহত অবস্থায় নিখিলকে প্রথমে বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ, পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়। ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, গোপালগঞ্জ জজ আদালতের নির্দেশে এএসআই শামীম হাসান আর তাঁর সোর্স রেজাউল করিম কারাগারে গেছেন।

এ থেকে মনে পড়ে গেলো লিমনের কথা। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার লিমন। ২০১১ সালের ২৩ শে মার্চ তৎকালীন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র লিমন হোসেন মাঠে গরু আনতে যায়। র‍্যাব তখন তাঁকে পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। লিমন সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। র‍্যাব তখন লিমনের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা করে। এতে ৩ বছরের মতন জেল খাটার সাজা পায় লিমন। আদালত সাজা কমিয়ে দিলে ২০১৪ সালে মুক্তি পায় সে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জড়িত ৭ জন র‍্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর পরিবার। আর লিমন হোসেন গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতক করে সেখানেই শিক্ষকতা করছেন।

আজ থেকে দুই বছর আগে ফেসবুক সরগরম ছিলো টেকনাফের একরামুল হক নামের কাউন্সিলর হত্যার বিষয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানের নামে খুন হন একরাম কাউন্সিলর। তারিখ ছিলো, ২৬ শে মে ২০১৮। গুলি করার আগে তাঁর দুই মেয়ে আর স্ত্রীর সাথে কথা বলার ভয়েস রেকর্ড শুনে জাতি চমকে উঠেছিলো। একরাম হত্যার একবছর পর ২৬ শে মে, ২০১৯ সালে তাঁর স্ত্রী বিবিসি-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁরা কোন মামলা করেননি। স্থানীয় নেতারা মামলা করতে নিষেধ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিবেন। প্রধানমন্ত্রীকে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনো পর্যন্ত সেই ব্যবস্থাও হয় নি।

২০ শে মার্চ,২০১৫। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশ পাওয়া যায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। দেশজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়। বিচার অধরাই রয়ে যায়। শেষ খবর, দুই অভিযুক্ত সার্জেন্ট জাহিদ এবং সিপাহী জাহিদকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বদলি করে দেয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত কিংবা ছত্রছায়ায় ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা যতটা ঘটে সমতলে তাঁর চাইতে কয়েকগুণ বেশি হয় পাহাড়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে,”পার্বত্য চট্টগ্রামে”। সেখানকার একটি কুখ্যাত ঘটনা কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা। ১১ ই জুন, ১৯৯৬ রাঙামাটির নিউ লাইল্যাঘোনার নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা। তাঁর দুই ভাই টর্চের আলোতে অপহরণকারীদের দেখেছেন বলে বারবার উল্লেখ করেন। জনৈক লে.ফেরদৌসের নাম আসে বার বার!! কিন্তু, সমাধান আসে নি। ৩৫ বারের মতন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় এই কেসে। শেষমেশ ২০১৬ সালে কেস ক্লোজ হয়ে যায়।

১৯৯৫ সালের ২৩ শে আগস্ট মা’কে দেখার জন্য ঢাকার ধানমন্ডির গৃহকর্তার বাসা থেকে পালিয়ে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজে চড়ে বসে ১৪ বছরের কিশোরী গৃহকর্মী ইয়াসমিন। বাস কন্ডাক্টর দশ মাইল এলাকায় ইয়াসমিনকে স্থানীয় পান দোকানদার জোবেদ আলী,ওসমান গণি,রহিমদের কাছে নামিয়ে দিয়ে বলে নিরাপদে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দিতে। একটু পরে টহল পুলিশের ভ্যান এলে পুলিশ ভ্যানেই ইয়াসমিনকে তুলে দেয়া হয়!! পুলিশ সদস্যরা দশমাইল আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। পরদিন সকালে ইয়াসমিনের লাশ পাওয়া যায় দিনাজপুরের দশমাইল ব্র‍্যাক অফিসের সামনে। পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। “একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার” শীর্ষক কেস সাজানোর চেষ্টা হয়। স্থানীয় এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল ২৫ শে আগস্ট দৈনিক উত্তরবাংলা’র সম্পাদক মতিউর রহমানকে জানান পুলিশ হেফাজতে এক কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। মতিউর রহমান খবর ছাপাতে গেলে পুলিশ তাঁর প্রেসের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জনাব রহমান পাশের বাসার থেকে লাইন এনে সংবাদ ছাপান। দেশ ফুঁসে ওঠে।আন্দোলনে ৭ জন নিহত হয়।১৯৯৭ সালে অভিযুক্ত দুই পুলিশ গ্রেফতার হন। অপর অভিযুক্ত অমৃত লাল ২০০৪ সালে গ্রেফতার হন। তাঁদের সবারই ফাঁসি হয়।

বাংলাদেশ পুলিশ আর সেনাবাহিনীর জন্ম অন্যান্য দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্মের চাইতে ভিন্ন। জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি জনযুদ্ধে অংশ নিয়েই এই দেশে পুলিশ,বিডিআর ( এখন বিজিবি), সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছে। এদের শরীরে অপরাধের কলংক লাগার অর্থ পুরো জাতিই কলংকিত হওয়া।

এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে। শুধু ক্রসফায়ারে দিলেই এর সমাধান হবে না। এতে অপরাধী দমন হবে অপরাধ দমন হবে না। প্রত্যেক অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় নেয়া দরকার। ভিক্টিম এবং অপরাধী উভয়ের জবানবন্দি সংরক্ষণ করা দরকার। পরবর্তীতে পুলিশ,সেনাবাহিনী,সরকারি প্রশাসনে যাঁরাই কাজ করবে তাঁদের সবাইকেই এই ঘটনা পড়ানো দরকার। তখন এই “কতিপয় বিপথগামী সদস্য” বলে যেই শ্রেণীকে উল্লেখ করা হয়। তাঁরাও আর থাকবে না বলে আমার বিশ্বাস। একজন অপরাধী কেন অপরাধ করলো?? কেন সে মানুষ থেকে অপরাধী হয়ে যায়?? এই বর্ণনা সংরক্ষণ করতে হবে। এতে অপরাধের গোড়া সমূলে উচ্ছেদ সম্ভব। শুধু শাস্তির ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চাইতে, অপরাধের বিবরণ সামনে এনে বোধশক্তি গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ।

অপরাধকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা ব্যর্থ। ভুল স্ট্রাটেজি। কারন,ইতিহাস ফিরে ফিরে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj