মোঃ আজিজুর রহমান দুলু
উইকিপিডিয়া অনুসারে “ওহী” শব্দের আভিধানিক অর্থ (ইসলামিক অর্থ নহে) হচ্ছে, এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা গ্রহণকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে এ শব্দটি ইলকা বা মনের মধ্যে কোনো কথা নিক্ষেপ করা ও ইলহাম বা গোপনে শিক্ষা ও উপদেশ দান করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। আমি আমার এই লেখায় এই অর্থে ইহা ব্যবহার করেছি, ইসলামিক অর্থে নয়। যাই হোক এবার আসি আসল কথায়।
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগ সংক্রমন পরিস্থিতির কারনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে ইতোমধ্যে যে সকল বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে সেই সকল বিজ্ঞপ্তির মধ্যে ২১৪ এবং ২৩০ নম্বর বিজ্ঞপ্তি হতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে বাংলাদেশের অধঃস্তন আদালতসমূহে অতীব জরুরী বিষয় গুলিকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হইতে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে । কিন্তু উভয় বিজ্ঞপ্তির কোন একটিতেই অতীব জরুরী বিষয় কি কি তাহার সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন জেলায় করনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ছুটির শুরু থেকে ০২.০৬.২০২০ ইংরেজি তারিখ পর্যন্ত একটি জেলা ব্যতীত (শেরপুর জেলার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নালিশ দাখিল ও আসামিদের আত্মসমর্পণের বিষয়কেও অতীব জরুরী বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন) সকল জেলায় শুধুমাত্র হাজতি আসামীদের জামিন শুনানি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে গ্রহণ করা হয়েছে।
গত ০৩.০৬.২০২০ ইংরেজি তারিখে বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন আইনজীবীদের মাধ্যমে শোনা গেল যে শুধুমাত্র দি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার অধীন সংঘটিত অপরাধের নালিশ আমলে গ্রহণকারী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগন ইমেইলের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন। গত ০৪.০৬.২০২০ ইংরেজি তারিখে ঢাকা আইনজীবী সমিতি হতে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী জানা যায় যে ঢাকার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার অধীন সংঘটিত অপরাধের নালিশ গ্রহণ করিতে সদয় সম্মতি প্রদান করেছেন । উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “ন্যায় বিচারের স্বার্থে উক্ত আইনের মামলার ফাইলিং প্রত্যেক আমলি আদালতে ইমেইলের মাধ্যমে পাইলিং করার জন্য অনুরোধ করা হলো এবং পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালতের আদেশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ফৌজদারী কার্যবিধি এর ২০০ ধারার বাদীর জবানবন্দি দেওয়া যাবে।”
সংবিধান ও হাইকোর্ট ডিভিশন রুলস, ১৯৭৩ অনুসারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন হতে প্রাকটিস ডাইরেকশন প্রদান করতে হবে এবং উক্ত বিভাগ হইতে প্রদত্ত প্রাকটিস ডাইরেকশন ব্যতীত অধস্তন আদালতের কোন বিচারক তার সম্মতির ভিত্তিতে কোন নালিশ গ্রহণ করতে পারেন না। হাইকোর্ট বিভাগ হইতে প্রাকটিস ডাইরেকশন এর প্রয়োজন যদি না হইত এবং অধস্তন আদালতের বিচারকের সম্মতির উপর ভিত্তি করে যদি বিচারকার্য চালানো যাইত তাহলে উপরোক্ত ২১৪ এবং ২৩০ নম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করার প্রয়োজন হতো না।
অন্যান্য নালিশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র যুক্তির খাতিরে দি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার নালিশ এবং পেনাল কোডের ৩০২ ধারার নালিশ এর মধ্যে সর্ব দিক থেকেই পেনাল কোডের ৩০২ ধারার নালিশ অধিক অতীব জরুরী বিষয়। দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ৪ ধারায় complaint এর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার মাধ্যমে যে কোনো ধরনের complaint বা নালিশ কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। complaint বা নালিশের কোন ধরনের শ্রেণীভেদ বা শ্রেণীকরণ করা হয়নি। তাই সাধারণভাবে যে কোনো একটি আইনের অধীনে কোন অপরাধ নালিশ আকারে ফাইলিং করার সুযোগ প্রদান করার অর্থ হলো সকল প্রকার complaint বা নালিশকে ফাইলিং করার সুযোগ দিতে হইবে। আর সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ হইতে জারিকৃত বিজ্ঞপ্তির কোনটিতেই উল্লেখ করা হয়নি যে দি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার নালিশ শুধুমাত্র ফাইলিং করা যাইবে। তাহলে প্রশ্ন জাগে কোন ওহী এর মাধ্যমে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার নালিশ ফাইলিং করার জন্য সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন? আবার প্রশ্ন জাগে করোনাকালীন এতদিন উক্ত সম্মতি জ্ঞাপন করলেন না কেন?
কেন যেন মনে হয়, ১৮৮১ সাল হতে ১৯৯৪ ইংরেজি সময় পর্যন্ত দীর্ঘ ১১৪ বছর যে ঘটনাটি অর্থাৎ চেক ডিজঅনারের ঘটনাটি সিভিল বিষয় ছিল সেই বিষয়টি ১৯৯৪ সালে হঠাৎ করে ইন্ডিয়া কে অনুসরণ করে (যেহেতু ইন্ডিয়া ১৯৮৮ সালে চেক ডিজঅনারের বিষয়টি স্ট্রীকট ক্রিমিনাল রেস্পন্সিবিলিটি এর আওতায় আনেন) স্ট্রীকট ক্রিমিনাল রেস্পন্সিবিলিটি এর আওতায় আনেন। অথচ International Covenant on Civil and Political Rights, 1976 এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে, “No one shall be imprisoned merely on the ground of inability to fulfil a contractual obligation” অর্থাৎ কোন ব্যক্তি কে চুক্তিকৃত দায়বদ্ধতা পালন না করার অক্ষমতায় কারারুদ্ধ করা যাবেনা ।” মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশ উক্ত আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার দলিলে একটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ভারত এবং ভুটানে চেক ডিজঅনারের বিষয়টি যে মাত্রায় ও কঠোরতায় স্ট্রীকট ক্রিমিনাল রেস্পন্সিবিলিটি এর আওতায় আনা হয়েছে তাহা পৃথিবীর আর কোন দেশে সে মাত্রায় ও কঠোরতায় দেখতে পাবেন না। রাষ্ট্র এখানে আন্তর্জাতিক আইন এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রচলিত আইন ও রীতি কে উপেক্ষা করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষদের উপর বিমাতাসুলভ আচরণ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ হতে জারিকৃত প্রাকটিস ডাইরেকশন বা বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই অদৃশ্য কারণে বা নির্দেশে নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার নালিশ ফাইলিং গ্রহণ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আন্ত বৈষম্যঃ দি নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ এ তিন ধরনের নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এর কথা বলা হয়েছে। তিন ধরনের নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট হলো চেক, প্রমিসরি নোট এবং বিল অব এক্সচেঞ্জ। উক্ত আইনটি ১৮৮১ সালে রচিত হয়েছিল উক্ত তিন ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট ক্ষেত্রে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে যখন উক্ত আইনের সংশোধন করা হলো তখন শুধুমাত্র চেক ডিজঅনারের বিষয়টি স্ট্রীকট ক্রিমিনাল রেস্পন্সিবিলিটি এর আওতায় আনা হলো যার মাধ্যমে উক্ত আইনের তিনটি বিষয়ের মধ্যে আন্ত বৈষম্য তৈরি হলো যাহা সংবিধানের অনুচ্ছেদ অনুসারে অসাংবিধানিক।
যে উত্তম পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করি নাঃ দি নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ এ উল্লেখিত তিন ধরনের নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এর কার্যকারিতার জন্য দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর, ১৯০৮ এর আদেশ ৩৭ বিধি ২ এ যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে উক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করলে দি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার নালিশ নিষ্পত্তি করতে যে সময় লাগে তার থেকে কমপক্ষে ১০ গুন কম সময়ে উক্ত বিষয়ে নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট চেক হোল্ডার তার পাওনা পাইতে পারেন। দি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাকট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার নালিশ নিষ্পত্তি হতে গড়ে দুই বছর সময় লাগলে উক্ত একই বিষয় দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর, ১৯০৮ এর আদেশ ৩৭ বিধি ২ এর অধীনে মাত্র দুই মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব।উক্ত আদেশ ৩৭ বিধি ২ এর অধীনে দাখিলকৃত আবেদনটি বিজ্ঞ জেলা জজ প্রথম দিন গ্রহণ করেই ১৪ দিনের সুযোগ দিয়ে বিবাদীকে হাজির হয়ে তার বক্তব্য প্রদানের জন্য নোটিশ প্রদান করবেন। বিজ্ঞ জেলা জজ ইচ্ছা করলেই ১৪ দিনের বেশি সময় দিতে পারবেন না কেননা উক্ত আদেশ অনুসারে প্রদত্ত নোটিশের ফরমে ১৪ দিন সময় প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো বর্তমানে বলবৎযোগ্য সিপিসি অনুসারে বাদী নিজেই আদালতের অনুমতিক্রমে নিজের মামলার নোটিশ বিবাদীকে জারী করিতে পারিবেন। এভাবে জারি করার পর, উক্ত আদেশ এর অধীনে দাখিলকৃত মামলায় অর্থাৎ সামারি সুট এ বিবাদী সরাসরি এসে জবাব দাখিল করিতে পারিবেন না। বিবাদীকে হাজির হয়ে আদালতের অনুমতি গ্রহণ করিতে হইবে। আদালত অনুমতি প্রদান না করিলে বাদীর দাখিলকৃত আবেদনের উপর ভিত্তি করে ডিগ্রি প্রদান করিতে পারিবেন কিংবা আদালতের অনুমতি নিয়ে জবাব দাখিল করিলে পরবর্তী ধার্য তারিখে আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে ডিক্রি প্রদান করিতে পারিবেন। আর আইনের এই বিষয়টির যথাযথভাবে চর্চা করিলে দি নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১ অধীনে কোনো নালিশ করার প্রয়োজন হইবে না। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, আমি কুড়িগ্রাম জেলায় অবস্থিত অধস্তন আদালত অর্থাৎ বিজ্ঞ জেলা জজ আদালতে উপরোক্ত আদেশের অধীনে তিনটি মামলা করেছি। হয়েছে বিবাদির প্রতি। দুর্ভাগ্যক্রমে করনা কালের কারণে পরবর্তী কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে।
ইসলামের ইতিহাস ও নীতি অনুযায়ী আমাদের দেশের বিচারকগণ যদি ১৩৮ ধারার অধীনে নালিশে উল্লেখিত আসামীর প্রতি সদয় কিংবা সিপিসির আদেশ ৩৭ বিধি ২ অনুসারে বিবাদীর প্রতি সদয় হয়ে বিচার করেন তাহলে হয়তো উক্ত আইনের গ্যাড়াকলে পতিত অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষ কারারুদ্ধ হইবে না।
মোঃ আজিজুর রহমান দুলু, সাবেক বিচারক ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মোবাইল-০১৭১৬৮৩২৩০৮ E-mail: azizurrahmandulu@gmail.com
মতামত লেখকের সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত এজন্য তিনি নিজেই দায়বদ্ধ থাকিবেন।