অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
বাংলাদেশের প্রায় সব পারিবারিক আইনে পিতাই সন্তানের অভিভাবক। তবে বাবা-মায়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ কিংবা বাবার মৃত্যুর পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সন্তানকে হেফাজতে রাখার অধিকার পেয়ে থাকেন মা। প্রথাগত এ আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছেন বাংলাদেশের আদালত। সাহেদ আর নিপার বিয়ে হয়েছে প্রায় চার বছর আগে। সংসারে বনাবনি না হওয়ায় সাহেদ একপর্যায়ে নিপাকে তালাক দেয়। বিচ্ছেদ হওয়ার পর তাদের চার বছরের ছেলে নাহিদকে নিজের কাছে রেখে দেয় সাহেদ। এমনকি মায়ের সঙ্গে দেখাটুকু পর্যন্ত করতে দেয় না। এমতাবস্থায় নিপার কাছে আইনি কোনো অধিকার আছে কি, যার মাধ্যমে সে তার সন্তানের দাবি করতে পারে?
মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তানের হেফাজতের অধিকার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মায়ের হাতে থাকে। সন্তানের মালিকানা সংক্রান্ত ব্যাপারে আইনে দুটি নীতি প্রচলিত আছে। একটি অভিভাবকত্ব আরেকটি হেফাজত। পিতা-মাতার বিচ্ছেদ অথবা যে কোনো একজন বা দুজনের মৃত্যুর পরই অভিভাবকত্বের প্রশ্নটি সামনে আসে। প্রায় সব পারিবারিক আইনেই সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক থাকেন পিতা। তবে মুসলিম আইনে শিশু সন্তানের দেখাশোনার বিষয়ে (জিম্মাদারের ক্ষেত্রে) সবচেয়ে বড় অধিকারী হলেন মা। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্তানের জিম্মাদার হয়ে থাকেন; কিন্তু কখনো অভিভাবক হতে পারেন না। এই সময়কাল হলো ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ বছর আর মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়োঃসন্ধিকাল পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে বা স্বামী মারা গেলে ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়োঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে, এটাই আইন।
এক্ষেত্রে মায়ের অধিকার সর্বাগ্রে স্বীকৃত। এ সময়ের মধ্যে মায়ের অগোচরে যদি বাবা জোরপূর্বক সন্তানকে নিজের হেফাজতে গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে বাবার বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা পর্যন্ত দেয়া যাবে। ৪৬ ডিএলআর-এর আয়েশা খানম বনাম মেজর সাবি্বর আহমেদ মামলার মাধ্যমে এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণত সুনি্ন হানাফি আইনের অধীনে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সন্তানের হেফাজতের কোনো অধিকার মায়ের কাছে অবশিষ্ট থাকে না। তবে পরে আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, শুধু নাবালক থাকাকালেই নয়, সন্তানের কল্যাণার্থে নির্দিষ্ট বয়সের পরেও মায়ের জিম্মাদারিত্বে সন্তান থাকতে পারে।
যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে- সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন। আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডিএলআরের মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, মুসলিম আইনে মা সন্তানের আইনগত অভিভাবক নন; কেবলমাত্র জিম্মাদার বা হেফাজতকারী। মাতার অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদারি মায়ের নিকটাত্মীয়দের কাছে চলে যাবে।
এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ক্রমধারা অবলম্বন করা হবে। মায়ের অবর্তমানে নাবালক শিশুর হেফাজতকারী পর্যায়ক্রমে হবেন মায়ের মা (নানি, নানির মা, যত ওপরের দিকে হোক), পিতার মা (দাদি, দাদির মা; যত ওপরের দিকে হোক), পূর্ণ বোন (মা, বাবা একই), বৈপিত্রেয় বোন (মা একই কিন্তু বাবা ভিন্ন), আপন বোনের মেয়ে (যত নিচের দিকে হোক), বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে (যত নিচের দিকে হোক), পূর্ণ খালা (যত ওপরের দিকে হোক), বৈপিত্রেয় খালা (যত ওপরের দিকে হোক), পূর্ণ ফুফু (যত ওপরের দিকে হোক)। উলি্লখিত, আত্মীয়রা কেবল ক্রমানুসারে একজনের অবর্তমানে বা অযোগ্যতার কারণে অন্যজন জিম্মাদারিত্বের অধিকারী হবেন।
কিছু কারণে মা তার জিম্মদারিত্বের অধিকারটুকু হারাতে পারেন। নিচের যে কোনো এক বা একাধিক কারণে মা এই অধিকার হারাবেন: ১. নীতিহীন জীবনযাপন করলে, ২. যদি এমন কারো সঙ্গে তার বিয়ে হয় যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়, ৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে ও দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে, ৪. বিয়ে থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে, ৫. যদি সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে, ৬. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেয়। তবে স্মর্তব্য যে, আদালতের আদেশ ছাড়া সন্তানের জিম্মাদারের অধিকার থেকে মাকে বঞ্চিত করা যায় না।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ ডিএলআরের জোহরা বেগম বনাম মাইমুনা খাতুন মামলায় আদালত বলেন, নিষিদ্ধ স্তরের বাইরে মায়ের বিয়ে হলেই মায়ের কাছ থেকে হেফাজতের অধিকার চলে যাবে না। মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে তাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই। মা অথবা অন্যান্য নারী আত্মীয়দের অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদার হতে পারেন যারা তারা হলেন: বাবা, বাবার বাবা (যত ওপরের দিকে হোক), আপন ভাই, রক্তের সম্পর্কের ভাই, আপন ভাইয়ের ছেলে, রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে, বাবার আপন ভাইয়ের ছেলে, বাবার রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে। মনে রাখতে হবে, একজন পুরুষ আত্মীয় একজন নাবালিকার জিম্মাদার কেবলমাত্র তখনই হতে পারবেন যখন তিনি ওই নাবালিকার নিষিদ্ধস্তরের আত্মীয় হন। মুসলিম আইনে কোনো নাবালক শিশুর সম্পত্তির তিন ধরনের অভিভাবক হতে পারে।
আইনগত অভিভাবক, আদালতকর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক এবং কার্যত অভিভাবক। আইনগত অভিভাবকরা হলেন_ বাবা, বাবার ইচ্ছাপত্রে (উইল) উলি্লখিত ব্যক্তি, বাবার বাবা (দাদা), বাবার বাবার ইচ্ছাপত্রে (উইল) উলি্লখিত ব্যক্তি। উলি্লখিত আইনগত অভিভাবকরা কিছু জরুরি কারণে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে পারেন, ওই সন্তানের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য তার অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি অথবা বন্ধক দিতে পারেন কিংবা নাবালকের ভরণপোষণ, উইলের দাবি, ঋণ, ভূমিকর পরিশোধ ইত্যাদির জন্য একজন আইনগত অভিভাবক নিচের এক বা একাধিক কারণে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন।
যেমন: ক. ক্রেতা দ্বিগুণ দাম দিতে প্রস্তুত, খ. স্থাবর সম্পত্তিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, গ. সম্পত্তিটি রক্ষণাবেক্ষণে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। যখন কোনো আইনগত অভিভাবক পাওয়া যায় না তখন আদালত নাবালকের সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত অভিভাবকরাই হলেন আদালতকর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক। তবে এই অভিভাবক আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো কারণেই সম্পত্তির কোনো অংশ বিক্রি, বন্ধক, দান, বিনিময় বা অন্য কোনো প্রকার হস্তান্তর করতে পারবে না। নাবালককে রক্ষার জন্য আইনগত অভিভাবক বা আদালত নিযুক্ত অভিভাবক না হয়েও যে কেউ নাবালকের অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন।
বাস্তবে এ রকমভাবে যিনি অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন তিনিই হলেন কার্যত অভিভাবক। তবে তিনি কোনো অবস্থাতেই সম্পত্তির স্বত্ব, স্বার্থ বা অধিকার হস্তান্তর করতে পারবেন না। সন্তান বড় হলে বিয়ে দিতে হবে এক্ষেত্রে অভিভাবক কে হবে? ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ২ ধারা অনুযায়ী ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স ১৮ হতে হবে এবং এটি বিয়ের একটি শর্ত। ফলে সন্তানের বিয়ের অভিভাবকত্ব বিধানটি বর্তমানে প্রযোজ্য নয়।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান কলামিস্ট ও আইনজীবী জজ কোর্ট, মেহেরপুর E-mail:mizanmpur06@gmail.com