অ্যাডভোকেট আয়েশা সিদ্দিকা
ছেলেবেলা থেকে কেবল একটি নামের সাথেই বিভ্রাট শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখেছি আর তা হলো “বিদ্যুৎ বিভ্রাট।”কিন্তু Digitalisation এর সুবাদে বর্তমান যুগে আরো বিভিন্ন ধরণের বিভ্রাট বা বিভ্রান্তি এর কথা আমরা জানতে পারছি। যেমনঃ প্রেম বিভ্রাট,বিবাহ বিভ্রাট,নাম বিভ্রাট,শব্দ বিভ্রাট। ২০১৭ সালে এক অদ্ভূত বিভ্রাটের আলোচনা পত্রিকায় আমরা দেখেছিলাম।আর তা হলো অস্ট্রেলীয় সংবাদ সংস্থা ABC News-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল,কয়েক ডজন ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে কারণ সিডনি’র “Air Traffic Control System” এ বিকাল পাঁচটায় একটি ‘সিস্টেম সফটওয়্যার বিভ্রাট’-এর ঘটনা ঘটে। যাই হোক,Globalisation এর যুগে শব্দ নিয়ে আজকাল যেসব বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে তাই আলোচনা করবো।
বর্তমান যুগে প্রায় সময়ই আমরা এই শব্দ বিভ্রাটে পড়ে থাকি। বাংলা আর ইংলিশ মিশ্র প্রয়োগের কারণেই এ অবস্থা।শব্দ বিভ্রাটে পড়েনি এমন মানুষ আজকাল পাওয়া দুষ্কর। আমি নিজেও পড়েছি এই রকম কিছু ঘটনায়। বাংলা বিষয়ের আমার এক শিক্ষক আছেন যিনি এই রকম ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে.. বর্তমান সময়ে কিছু ছেলেমেয়ে আছে যারা নিজেদের Smart বানাতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষা ভুলে কথায় কথায় Yes man,No man,Shit man বুলি আওড়ায়। আর এই শব্দ বিভ্রাটের জন্য এরাই দায়ী।তবে অনেক ক্ষেত্রে বোঝার ভুলের কারণেও অনেকে শব্দ বিভ্রাটে পড়ে থাকেন।যেমনঃ প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকারের অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন’ বইয়ে অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তেমনই একটি ঘটনা পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহর শোকসভাকে কেন্দ্র করে।ময়মনসিংহের সেই শোকসভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন একজন বিজ্ঞ আইনজীবী। তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
বাংলায় বক্তৃতা দিতে গেলেও তিনি অনেক ইংরেজি ইডিয়মের এমন অনুবাদ করতেন যা শ্রোতাদের মধ্যে বেশ হাস্যরসের সঞ্চার ঘটাতো। জিন্নাহ সাহেবের শোকসভায় বক্তৃতা তার জন্য হাস্যরসের বদলে করুণ রস সঞ্চার করল।জিন্নাহ সম্পর্কে দুয়েকটি প্রশংসামূলক বাক্য উচ্চারণের পরই তিনি বলতে লাগলেন, ‘জিন্নাহ ছিলেন একজন …জিন্নাহ ছিলেন একজন …।’ উপযুক্ত বাংলা শব্দটি তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শব্দ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ বলে উঠলেন, “জিন্নাহ ছিলেন একজন দৈত্য।” আর যায় কোথায়?শ্রোতাদের কে একজন চিৎকার করে উঠল,‘কী, জিন্নাহকে দৈত্য বলল? এত বড় অপমান?ধর ব্যাটাকে।’ মরহুম ‘জাতির পিতা’র অপমানে বহু শ্রোতাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বক্তাকে ধাওয়া করল।তখন জেলা জজ না আর কে একজন কোনো রকমে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন এবং এভাবেই তিনি ‘জনতার ক্রোধ’ থেকে সেদিন রক্ষা পান।
The fact is that ইংরেজি ‘Giant’ শব্দটির বাংলা করে বিজ্ঞ আইনজীবী বক্তা জিন্নাহকে ‘দৈত্য’ আখ্যা দিয়ে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ফল হল বিপরীত।এতে সম্মানের বদলে অপমান করা হয়েছে ভেবেই সেই সভার জিন্নাহ ভক্ত শ্রোতারা উত্তেজিত হয়ে উঠে বক্তাকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল।বেচারা আইনজীবী ভদ্রলোক যে ভুলটি করেছিলেন তা বিরল নয়। এ জন্য তাকে খুব একটা দায়ী করা যায় না।শব্দ যদি স্থান কাল ভেদে ভিন্ন অর্থ বহন করে অর্থাৎ বহুগামী আচরণ করে তবে ব্যবহারকারীর আর কী দোষ?তিনি তো নিমিত্ত মাত্র। তাই শব্দের চালচিত্র আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও এর কোপানলে পড়লে মানুষ বিব্রত হতে বাধ্য।আরো একটি ঘটনা বলি।এক ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করতে গেছেন এক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। মানুষের দুর্গতির কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের বাঁশ দেব।’ এ কথা শুনেই জনগণ তাকে ধাওয়া করল। বিক্ষুব্ধ জনতাকে কে বোঝাবে যে ভেঙ্গে যাওয়া ঘরবাড়ি নির্মাণের উপকরণ হিসেবেই কেবল সেই নেতা বাঁশ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। শব্দের Statecraft বিভ্রান্ত করে দেয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরও।
ইংরেজি পরীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়েছে ‘বৃষ্টি পড়ছে’ বাক্যটির অনুবাদ। এক শিক্ষার্থী লিখলো -“Brishty is reading.”সে ভুল লিখলো না শুদ্ধ সেই মীমাংসা কীভাবে হবে? ইংরেজির প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলোই তাই এ ভাষার রাজনীতিও বোঝা প্রয়োজন।স্ত্রীর বিরতিহীন গালাগাল থেকে বাঁচার জন্য এক স্বামী কিছুদিন ধরে অজ্ঞাতবাস করছেন। একদিন স্বামী ফোন করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘Darling, what are you doing?’ স্ত্রীর জবাব, ‘I am dying.’ স্বামী শুনে উৎফুল্ল হলেও বেদনার্ত চিত্তে বললেন, ‘Oh! How I will leave without you?’ স্ত্রী বললেন, ‘Idiot. I am dying my hair.’বেচারা স্বামী খুব হতাশ হলেন ইংরেজি ভাষার এ দ্বিচারিতা দেখে।
তবে শুধু শব্দকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অতি ব্যবহারে আমরা অনেক সময় শব্দের তাৎপর্য ও গ্রহণযোগ্যতা দুটোই নষ্ট করে ফেলি। ‘ফুলের মতো পবিত্র’ কথাটি উপমা হিসেবে অসাধারণ। কিন্তু যে কোনো নির্বাচনের আগে ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র,ফুলের মতো পবিত্র’ কথাটির ব্যবহার এত বেশি হয় যে ফুল বা পবিত্র কোনোটির পবিত্রতা আর বজায় থাকে না। এবার Character বা চরিত্রের গভীরে একটু প্রবেশ করা যাক।”Character is an invaluable asset.” অর্থাৎ ‘চরিত্র অমূল্য সম্পদ’- এ কথাটি না শুনে আমরা কেউ স্কুলের গণ্ডি পার হইনি।বিভিন্ন সদগুণের সমাহারকে আমরা চরিত্র বলি।যার মাঝে এ গুণাবলি অনুপস্থিত তিনি চরিত্রহীন।কিন্তু এভাবে চরিত্রের বিচার আমরা করি না। কোনো ব্যক্তি খুন, ডাকাতি, দুর্নীতি, প্রতারণা, নারী নির্যাতন করেও ‘চরিত্রবান’(Good Character) থাকতে পারেন।শুধু একটি কারণে তিনি ‘চরিত্রহীন’ (Characterless)হয়ে যান।
যদি একাধিক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে বা তিনি যদি পরকীয়া প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন তবে অন্যসব গুণ থাকলেও তিনি হয়ে যান ‘চরিত্রহীন’(Characterless)। আর যদি এক নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে অন্যসব দোষকে তিনি ধারণ করেন এরপরও তিনি ‘চরিত্রবান’(Good Character)থেকে যান আমাদের সমাজে। চরিত্র সম্পর্কে আমাদের এ অদ্ভুত মানসিকতা দেখে প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, “বাঙালির চরিত্র শরীরের কয়েক ইঞ্চি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ।” চরিত্র শব্দটির আরেক অর্থ ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য।যেমনঃ বস্তুর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য বোঝাতে চরিত্র কথাটি ব্যবহৃত হয়।
এ ক্ষেত্রেও বিপদের অন্ত নেই। ইংরেজি ‘Religion’ শব্দটির বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে ধর্ম।যেমন- ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান।অথচ বাংলা ‘ধর্ম’ শব্দটির অর্থ আরও বিস্তৃত। সেই বিস্তৃতি বুঝতে না পেরে এক ছাত্র পুরো শ্রেণীকক্ষে হাসির বন্যা বইয়ে দিয়েছিল।শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন ‘আগুনের ধর্ম পোড়ানো’ বাক্যটির ইংরেজী কি?ঐ ছাত্রটি তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল- ‘Burning is the religion of fire.’ শব্দের অর্থ বুঝতে আমরা ভুল করলেও আগুন সেই ভুল করে না।তার কাজ সে করবেই। কবিগুরু বলেছিলেন, “ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।’
তাঁর কথা আমরা রেখেছি। আগুন জ্বালিয়েছি, জ্বালছি,ভবিষ্যতেও জ্বালব- তবে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে নয়।আগুন জ্বালিয়েছি পোশাক শিল্পের কারখানায়,গরিব বস্তিতে,সংখ্যালঘুর উপাসনালয়ে ও বাসস্থানে। Generally শব্দের গোলমেলে বোঝার জন্য ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থের পার্থক্য জানাটা ভীষণ জরুরি। তা না হলে কি মহাবিপদ হতে পারে সেটা এক পণ্ডিতের গল্পের মাধ্যমে উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানবো। এক পণ্ডিত বিশেষ প্রয়োজনে রাতের বেলা একটি ঝোপের দিকে যাচ্ছিলেন। গ্রামের লোকজন তাকে ওখানে যেতে নিষেধ করল,কারণ সেখানে প্রায়ই বাঘে আক্রমণ করে।পণ্ডিত বললেন, “বাঘ আবার কী? মানে ব্যাঘ্র তো? ব্র্যাঘ্র শব্দ তৈরি হয়েছে (বি-আ-ঘ্রা+অ)এভাবে। ‘ঘ্রা’ ধাতুর অর্থ ‘ঘ্রাণ নেয়া’।
তাই ‘ব্যাঘ্র’ মানে ‘যে বিশেষ করে ঘ্রাণ নেয়’। ঐ ব্যাঘ্র আমাকে কী করবে?”এ সাহসে ভর করে পণ্ডিত ঝোপের ভেতর ঢুকলেন।হঠাৎ এক ব্যাঘ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।চিৎকার করে পণ্ডিত বললেন, ‘ওহে ব্যাঘ্র, এ তুমি কি করছো? তোমার তো কেবল ঘ্রাণ নেয়ার কথা,ভক্ষণ করছো কেন আমাকে?তুমি তো পাণিনির ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন করছো?’ ব্যাঘ্র পাণিনির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পণ্ডিতের শুধু ঘ্রাণ নয়,প্রাণ নিয়ে ছাড়ল। পরিশেষে বলতে চাই ভুল-বোঝাবুঝির কারণে শব্দ নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। ভুলবোঝাবুঝি হতেই পারে কিন্তু স্টাইল করতে গিয়ে যদি কোনো শব্দকে অপমান করা হয় তবে কিছুটা মাথা ব্যাথা হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলা শব্দ নিয়ে Stylish মানসিকতার আমুল পরিবর্তন দরকার।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট আয়েশা সিদ্দিকা লোপা, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।