সব
facebook apsnews24.com
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্ষুধার্ত মানুষ ও আমাদের তামাশা! - APSNews24.Com

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্ষুধার্ত মানুষ ও আমাদের তামাশা!

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্ষুধার্ত মানুষ ও আমাদের তামাশা!

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে দেশবাসী। মহামারি করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে না বাঁচতেই দ্রব্যমূল্য, জ্বালানী তেলসহ সকল জিনিসের উপর মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘরে ঘরে চলছে নিরন্ন মানুষের হাহাকার। দাম কমানোর নামে নানা কৌশল আবিস্কারের কথা মিডিয়াতে বলা হলেও তা শুণ্যের কোঠায়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) ঘোষণা করেছিলেন, আমার রাষ্ট্রের একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায় এর জন্য আমিই দায়ী হব। তিনি রাতের আঁধারে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের খোঁজখবর রাখতেন। কেউ অভুক্ত থাকলে নিজের কাঁধে খাবারের বস্তা বহন করে তার বাড়িতে দিয়ে আসতেন। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পরে এক রাতে তিনি বাতির আলোতে রাষ্ট্রীয় কাজ করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি বিশেষ প্রয়োজনে তার কাছে এলেন। আলী (রা.) সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে দিলেন।তারপরে আগত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। আগন্তুক কৌতূহলি হয়ে তার কাছে বাতি নিভানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দিলেন, এতক্ষণ আমি সরকারি কাজ করছিলাম। তাই সরকারি তেল ব্যবহার করেছি। এখন তো ব্যক্তিগত কাজ করছি। সরকারি বাতি ব্যবহার করলে এটা আমানতের খেয়ানত হবে।

খলিফা হারুন-অর রশিদের আমল। একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামী হিসেবে নতুন বিচারকের দরবারে হাজির করলেন। তার অপরাধ ছিল তিনি শহরের এক রেস্তারাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করেছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে আসামী জানালেন এক সপ্তাহ যাবত এতিম দু’নাতি সহ তিনি অনাহারে ছিলেন। নাতিদের ক্ষুধারত চেহারা ও কান্না সহ্য করতে না পেরে এ চুরির ঘটনা ঘটেছে। বিচারক এবার পুরো দরবারে চোখ বুলালেন। বললেন কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, পুলিশ প্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এ রায় দেয়া হবে। পরদিন সকালে সবাই হাজির হলেন। বিচারক ও যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণা করলেন-“বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদ- প্রদান করা হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হলো।

এবার বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ঐ বৃদ্ধা মহিলার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বিচারক বললেন যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয় সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। আমি যেহেতু তাঁর অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হউক আর এটাই হলো বিচারকের আদেশ। আদেশ যেন পালন করা হয় এবং বিচারক হিসাবে আমার উপর চাবুক মারতে যেন কোনো রকম করুণা বা দয়া দেখানো না হয়।

বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুই হাতে পর পর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতের ফলে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে। এরপর বিচারক বললেন “যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাবগ্রস্থ মহিলার ভরন-পোষণ করতে পারেন না। সেই নগরে তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমান ভাবে তাদেরকে মারা হোক।”

এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন “যে সমাজ একজন বৃদ্ধ মহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো।”

এবার মোট ৫০০ দিনার রৌপ্য মুদ্রাথেকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানাবাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বললেন “এগুলো আপনার ভরণপোষণের জন্য। আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুন-অর রশিদের দরবারে আসবেন। খলিফা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।

এবার খলিফার দরবারে হাজির ওই বৃদ্ধা। বিচারক চেয়াার থেকে নেমে এসে বললেন আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম । আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলীফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন।

এটা ভিন্ন গল্প। একরাতে নৈশভ্রমণে বের হয়েছেন খলিফা। মূলত এ ভ্রমণে তিনি রাজ্যের নাগরিকের সুখ-দুঃখের খোঁজ নিতেন। সে রাতে ছিল চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দূর যেতেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শোনা গেলেও অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সামনের দিকে এগোতে হলো। বেশ কিছু বালুময় বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার পর কান্নার আওয়াজ আসা স্থানটি নির্ণয় করা গেল। দেখা গেল নিভুনিভু আগুনের চিহ্ন। আরও কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা অবলোকন করার চেষ্টা করছেন খলিফা ও তার সঙ্গী। প্রথম বোঝা গেল এক মহিলা চুলায় কিছু রান্না করছেন। তার পাশে দুই শিশু খাবারের জন্য কান্না করছে। অথচ মহিলাটি বাচ্চাদের অতি শিগগিরই খাবার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে বেশকিছু সময় অতিবাহিত হলো। তারা দুজন ঠায় দাঁড়িয়ে এসব চিত্র দেখে যাচ্ছেন। এসব চিত্র দেখার ফাঁকে-ফাঁকে তারা নিজেদের মধ্যে কিছু ছোট ছোট আলাপও করছেন। এরই মধ্যে তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হলো বিষয়টি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বাচ্চাদের দেওয়া মহিলার স্বল্প সময়ের আশ্বাস ফুরাচ্ছে না। তখন তারা আগন্তুক হিসেবে মহিলার দিকে এগিয়ে গেলেন। একজন আগন্তুকের বয়স খানিকটা বেশি হলেও অপরজন ছিল যুবক। আগন্তুকরা জিজ্ঞেস করল বাচ্চাদের এভাবে কান্নার প্রকৃত কারণ কী?

তখন মহিলা অত্যন্ত অসহায়তার সঙ্গে বলতে লাগলেন, এই দুই বাচ্চা আমার সন্তান, আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমি সারা দিন চেষ্টা করেও তাদের জন্য কোনো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই তাদের সান্ত¡না দেওয়ার জন্য পাতিলের মধ্যে পাথর সিদ্ধ করছি এবং অপেক্ষা করছি কখন তারা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন আগন্তুকদের মধ্যে প্রথমজন খুব মর্মাহত হলেন এবং পাশের যুবককে তাদের খাবারের জন্য নিজ কাঁধে করে আটা এবং খেজুর নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্য নিয়ে ফিরে এলেন যুবক। এর অল্প সময় পরই মহিলা জানতে পারলেন তার জন্য খাদ্য বহন করে নিয়ে আসা ব্যক্তিই খলিফা হারুন অর রশীদের পুত্র মুহতাসীম।

পাঠক নিশ্চয়ই আপনারা সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নাম শুনেছেন। যিনি দিল্লিতে বসে ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজি শাসন পরিচালনা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় ইতিহাসেও একজন আলেকজেন্ডারের মতো শক্তিশালী কারো কথা উল্লেখ করা থাকুক। এজলাস ত্যাগের আগে সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজী কাজীকে বলেছিলেন, “আজ আপনি যদি আমার প্রতি কোনো প্রকার দুর্বলতা দেখাতেন তবে এই চাবুক নিয়েই এসেছিলাম যে, এটা দিয়েই আপনাকে শাস্তি দিতাম।” আর অপরদিকে, কাজীও তাঁর এজলাসে গোপনে রক্ষিত চাবুক দেখিয়ে সুলতানকে বলেছিলেন, “আপনি যদি আজ এজলাসে না এসে কোনো তালবাহানার আশ্রয় নিতেন তবে আমিই সরাসরি রাজদরবারে গিয়েই আপনাকে এ চাবুক দিয়ে আঘাত করতামই।”

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj