মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
গ্রীষ্মকালকে ফলের মৌসুম বলা হয়। এসময় যতো ফল-ফলাদি পাওয়া যায় অন্য কোনো মৌসুমে এতো ফল পাওয়া যায় না। বিশেষ করে আম এই মৌসুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, লোভনীয় ও বেশি চাহিদা সম্পন্ন ফল। পুষ্টিগুণেও আম অতুলনীয়। সববয়সের মানুষ আম কমবেশি খেতে পারে বা পছন্দ করে। চাহিদা বেশি থাকায় তাড়াতাড়ি আম বাজারজাত করতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় নামে। দেখা যায় ভরা মৌসুমে আমের দাম ও চাষিরা কম পায়। সে কারণে সিজনের একটু আগে বাজারজাত করতে চায়।
কিন্তু আম প্রাকৃতিক উপায়ে পরিপক্কতা লাভ করে। কিলিয়ে কাঁঠাল যেমন পাকানো সম্ভব নয় ঠিক তেমনি আমও অপরিপক্ক থাকতে পাকবে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা তখন অপরিপক্ক আম পাকানোর কৌশল হিসেবে কেমিক্যাল বা তাপ পদ্ধতি বা রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার করে। উক্ত অপরিপক্ক আমে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। আমের যে স্বাভাবিক গুণ বা স্বাদ থাকে তা নষ্ট হয় এবং কেমিক্যালযুক্ত আম গ্রহণে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়।
উচ্চ মাত্রায় কেমিক্যাল ব্যবহারে সুস্বাদু পাকা আমটি বিষাক্ত খাবারে পরিণত হয়। অনেক সময় বিষাক্ত আম শুধু নয় যেকোনো ভেজাল খাবার গ্রহণে কিডনি বিকল, এলার্জি, পেটের সমস্যা এবং উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রকম জটিল রোগ দেখা যায়। এই স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি জেনেও কিছু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় আমে বিষাক্ত মিশিয়ে পাকানোর চেষ্টা করে যা আইনত অপরাধ ও দণ্ডনীয়।
বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের মৌলিক অধিকার নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এ ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে কার্যকরী আইন বলবৎ রয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) বলছে, ‘খাদ্য নিরাপত্তা হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে পৃথিবীর সব স্থানের সব মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় পছন্দের খাবার পাওয়ার দৈহিক ও আর্থিক সুযোগ সৃষ্টি করা।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, খাদ্য নিরাপত্তার চারটি পিলার বা স্তম্ভ আছে। যথা- সহজলভ্যতা (availability), প্রবেশাধিকার (access), উপযোগিতা (utilization) ও স্থিতিশীলতা (stability)। বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য ভোক্তার অধিকার হিসেবে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। নিরাপদ খাদ্য ভোক্তার অধিকার বলে গণ্য হয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিরাপদ খাদ্যকে ভোক্তার অধিকার হিসেবে নেয় এবং এর ব্যত্যয় সেসব দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয় এবং নিরাপদ খাদ্যের জন্য যখন মানুষ দিশেহারা তখন খাদ্যে ভেজাল রোধ-সংক্রান্ত সব আইন ও অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করে ‘দ্য পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯’- রহিত করে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণীত হয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ও আমাদের সংবিধান মতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও সংসদ পিওর ফুড অ্যাক্ট ২০১৩ ও পিওর ফুড বিধিমালা ২০১৪ প্রণয়ন করেছে। এ আইন অনুযায়ী, নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য কোনো অপরাধ বা ক্ষতি সংঘটন বা সংঘটনের প্রস্তুতি গ্রহণ বা সংঘটনে সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো ঘটনার বিষয়ে কেউ ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ বা গ্রহণ করলে বা কোনো কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনা রেকর্ড করলে ওই ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও ওই অপরাধ বা ক্ষতি সংশ্লিষ্ট মামলা বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ যেসব কার্যকলাপকে অপরাধ গণ্য করা হয়েছে তা হলো- ঙ. খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধদ্রব্য মিশ্রণ করা; আর খাদ্যে নিষিদ্ধ তথা বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত করলে কি শাস্তি হবে কোথায় বিচার হবে তার কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হলো। মামলা ও বিচার হবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮ অনুযায়ী, আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সরকার বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি, নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক এ আইনের অধীনে লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারার্থে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত আমলে নিতে পারবেন। যদি কোনো ব্যবসায়ী মনে করেন, তিনি যেসব খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ বা সরবরাহ বা বিক্রয় করেছেন, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো আইন বা বিধি মানা হচ্ছে না, ভোক্তার জন্য অনিরাপদ, তবে তার কারণ উল্লেখ করে তিনি তা দ্রুত সন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ খাদ্যদ্রব্য বাজার বা ভোক্তার কাছ থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবেন এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে তা জানাবেন।
ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে- জরিমানা ও শাস্তির বিধান আরও সুনির্দিষ্ট যেমন জীবননাশক বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক বা ভারী ধাতু বা বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত কোনো খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, আমদানি, প্রস্তুত, মজুত, বিতরণ, বিক্রয় বা বিক্রয়ের অপচেষ্টা করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। পূনরায় একই অপরাধ করলে সাত বছর থেকে অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনূন্য ১০ লাখ টাকা জরিমানা।
খাদ্য হিসেবে শুধু আম নয় যেকোনো পুষ্টিকর নিরাপদ খাবার ভোক্তার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমের মৌসুমে বিগত বছরের ন্যায় এবারও আম ভাঙার বা গাছ থেকে পাড়ার সময় নির্ধারণসহ বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত যদি ভ্রাম্যমাণ ডিউটিতে গিয়ে আমবাগানে মনিটরিং বা তদারকি করা জরুরি। তাহলে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীরা আমে বিষাক্ত স্প্রেসহ অপরিপক্ক আম পাড়া হতে বিরত থাকবে। নির্দিষ্ট সময়ে আম গাছ থেকে পাড়া হলে প্রাকৃতিকভাবে পেকে যাবে। আমের পুষ্টিগুণ ও স্বাদ অপরিবর্তিত থাকবে। কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকবে না।
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে আম চাষি বা বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বিভিন্ন সেমিনার, বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। তাছাড়া আমের বাগানমালিক, আম চাষি পর্যায়ে ও ব্যবসায়ীদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভোক্তাদের ও দায়িত্ব রয়েছে। সচেতন ভোক্তা হিসেবে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে অপরিপক্ক কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো আম খরিদ হতে বিরত থাকতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীরাও লোকসান এড়াতে অপরিপক্ক পাকা আম বাজারজাত করণে নিরুৎসাহিত হবে। বিদ্যমান আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। বছরের এই মৌসুমে আইন শৃঙ্খলা-বাহিনীসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিদ্যমান আইন সমূহের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন। আইন অনুযায়ী বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে পরিচালিত হতে পারে। আম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জেলা প্রশাসন মিটিং বা সবাই সচেতন করতে প্রচারের বিষয়ে উদ্যোগ ও সমন্বয় করতে পারেন।
লেখক: কলামিস্ট, কবি ও আইন গবেষক।
Email: bdjdj1984du@gmail.com