মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম |
ব্যবসায়ী মহসিন খান লাইভে এসে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রি মূলত দুটি কারণে; এক. তিনি ফেসবুক লাইভে এসে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বকে দোষারোপ করেছেন, দুই. আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া মহসিন খান হলেন চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর। এখন মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনাটি সমসাময়িককালে হলেও সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমের আত্মহত্যা তত্ত্বটি আবার সামনে এসেছে। যেটি বিশ্লেষণের জোর দাবি রাখে। মূলত আত্মহত্যার ধরন বা তত্ত্বের মর্মকথা যাই বলি না কেন, যেকোনো আত্মহত্যা সমাজ, রাষ্ট্র বা পরিবারের জন্য কলঙ্ক ও অমঙ্গলজনক। সে কারণে কেন আত্মহত্যা করে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি হবে সে বিষয় গবেষণার জোর দাবি রাখে। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধিতে লেখাটি কাজে লাগবে হয়তো।
এমিল ডুর্খেইমের মতে, আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে আত্মহত্যা সম্পর্ক নিরূপণ করেছেন। অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি আত্মহত্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তাঁর Suicide গ্রন্থে আত্মহত্যার জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং ভৌগোলিক কারণসমূহকে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক কারণসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন। তিনি আত্মহত্যাকে সামাজিক সংহতির সঙ্গে সম্পর্কিত করেন। তিনি মূলত অন্যের যুক্তি খণ্ডন করেন তারপর আলোচ্য বিষয়ে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আত্মহত্যাকে শ্রমবিভাজনের নেতিবাচক দিক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা সামাজিক সংহতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে এ্যারোন বলেন, আত্মহত্যা হলো আত্মহত্যাকারী কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ঘটনা, যা মৃত্যু ঘটায়। Suicide is every case of death resultiry directly or indirectly from a positive or negative act performed by the victim himself and which strives to produce this result)। তাই বলা যায়, আত্মহনন করা তথা নিজের জীবন নিজের দ্বারা নিঃশেষ হওয়া হলো আত্মহত্যা। আত্মহত্যা প্রসঙ্গে ডুর্খেইম বলেন, যারা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত তারা আত্মহত্যা করে। আবার যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন তারাও আত্মহত্যা করে। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের আত্মহত্যার ধারণা তিনি দেন। তিনি প্রধানত তিন ধরনের আত্মহত্যার উল্লেখ করেছেন।
এগুলো হলো:
(১) আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা (Egoistic Suicide),
(২) পরার্থপর আত্মহত্যা (Altruistic Suicide) এবং
(৩) নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা (Anomic Suicide)|
(১) আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা: সমাজ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংহতির অভাব দেখা দিলে এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে। সমাজ থেকে ব্যক্তি যখন নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে তখন এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে। সচরাচর যে সকল সমাজে সামাজিক সংহতি কম থাকে সে সকল সমাজে আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হয়। ডুর্খেইম পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখান যে, বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতদের মধ্যে, মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে, গ্রামবাসীর চেয়ে নগরবাসীর মধ্যে এ ধরনের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।মহসিন খানের আত্মহত্যা হতে দেখলাম উনি নগরে একাকী বসবাস করতেন এবং তিনি মনে করতেন যে, তিনি মারা গেলেও কেউ তাকে দেখতে আসবে না, যা তিনি লাইভে বলেছেন। তার মানে তিনি নিজেকে সমাজ থেকে শুধু নয়, পরিবার থেকে নিঃসঙ্গ ভাবা শুরু করেছিলেন, আর তারই ফলাফল হলো আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা বা (Egoistic Suicide)|
মহসিন খান একজন সফল ব্যবসায়ী যার কোনো অভাব ছিল না। তাঁর স্ত্রী একমাত্র ছেলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া বসবাসরত আর বড় মেয়ে জামাতার সঙ্গে ঢাকাতেই বসবাস করেন। কিন্তু কেন এই মৃত্যু? ওনার লাইভ থেকে যেটুকু জানা গেল, তা হলো শুধুই নিঃসঙ্গতা। আর সে কারণে তিনি তাঁর অসুস্থতা বা রোগযন্ত্রণাকে সহ্য করতে না পেরে জীবনের মায়া ত্যাগ করে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। আত্মহত্যাকে কাপুরুষোচিত কাজ মনে করা হয়। যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাস হলো আত্মহত্যা মহাপাপ যা সকল বয়সী মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু ইগজাগতিকরা অনেকে আত্মহত্যাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা মনে করে। এমিল ডুর্খেইম মনে করেন, যখন সমাজে ব্যক্তির ওপর মূল্যবোধের প্রভাব হারিয়ে ফেলে তখন তাকে নৈরাজ্যমূলক অবস্থা বলে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে ব্যক্তি তার নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী আচরণ করে, যা সামাজিকভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যার প্রভাবে বা কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে। এ রকম পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করাকেই নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা বলে। সাধারণত যেকোনো বিপ্লব বা দুর্যোগের পর এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যেমন ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ের ফ্রান্সের সমাজ ব্যবস্থা, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর এ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে পারে।এ ছাড়া তিনি আরো এক ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেন, তা হলো নিয়তিবাদী আত্মহত্যা। এ ধরনের আত্মহত্যর ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ হয়ে থাকে। বিজ্ঞ বিচারক রাশেদুজ্জামান রাজা স্যার তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, রোগযন্ত্রণাক্লিষ্ট অথবা অশীতিপর একজন লোকের আত্মহত্যা করাকে সবাই কি কাপুরুষোচিত কাজ বলবে? বেঁচে থেকে তিনি কী সাহসী কাজ করতে পারতেন? “শুধু দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে” চাওয়া আলমগীর যদি বেকারত্বের তাড়নায় আত্মহত্যা করতো সেটাকে সবাই কাপুরুষোচিত কাজ বলতো। কারণ, সেটা হতো বেকারত্বের অভিশাপ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে না পারা। এটাকে যৌবন এবং তারুণ্যের অপমান হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। মহসিন খানের মতো অনেকেই নীরবে-নিভৃতে হয়তো স্বেচ্ছামরণের পথ বেছে নিচ্ছেন। অনেকেই পারিবারিক যত্ন-আত্তিতে সুখে দিনাতিপাত করছেন। এই পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতার বিষয়টিই মহসিন খান উল্লেখ করেছেন যা তাঁকে নিঃসঙ্গ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কিছু দিন আগে মুনিয়া নামের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ঘটনাটি পারিবারিক বন্ধনের এবং একজন অভিভাবকের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। মুনিয়ার মতো আমিও পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান, স্কুল পার হওয়ার আগে আমারও বাবা- মা দুজনেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, ওর মতোই অসহায়ত্ব আমার কৈশোরকে ছেয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি পেয়েছিলাম আমার ভাইয়ের আশ্রয়, ভাইয়ের ছায়া, আমার ভাই আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না, তবুও আমাকে ছেড়ে দেননি, হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করলেও ভাইয়েরা খোঁজখবর রেখেছেন এবং আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, কমপক্ষে অনার্সে ভর্তি পর্যন্ত সকল দায়-দায়িত্ব পালন করেছেন। আমিও চেষ্টা করেছি ভালো-মন্দ যাই হোক ভাইদের মাধ্যমেই সমাধান করতে। কিন্তু মুনিয়া মেয়েটার দুর্ভাগ্য সে একজন ভাই পেলেও দায়িত্বশীল ভাই পাননি, বোনটি হয়তো বা দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সক্ষম ছিলেন না। এজন্য পড়ালেখাও হয়তো বা ঠিকমতো করেননি আবার তার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল তার সৌন্দর্য, এরকম মেয়ে পেলে ভোগের চেষ্টা করবে না এমন পুরুষ খুব কমই আছেন, ফেসবুকে বড় বড় হুজুর আর নীতিবাক্য বলা লাখ লাখ লোক আছে তবে সু্যোগ পেলে তারা যে কি করবেন এটা যদি মনের স্ক্যানার থাকতো তবে বের করা যেতো। এই মেয়েটি একেবারেই যখন একা তখন তার সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সৌন্দর্য, এ বয়সে ভাবনার সুযোগ বা মেধা/জ্ঞানও ছিল না। স্বপ্নের রাজ্যে হাঁটা শুরু করেছিল সে, তবে সংসার, অর্থ, প্রেম, প্রেসার এত কিছু সামলানোর এবিলিটি তার ছিল না, তাই তার করুণ পরিণতি।
অথচ তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সরকারি চাকরিও করতেন, মাও সরকারি চাকরি করতেন, মেয়েটি বাবা-মায়ের চাকরির পেনশন থেকে যে ভাতা পেতো তা দিয়েই ভাই বা বোনের পরিবারে থেকে লেখাপড়া করে সুন্দর জীবন বেছে নিতে পারতো, কিন্তু ভাইবোন সেই সুযোগ দেননি, উল্টো সম্পত্তি নিয়ে নাকি দ্বন্দ্বও হয়েছে, এরকম অবস্থায় তার যে পরিণতি সেটা খুব স্বাভাবিক। ভাইবোন যদি দায়িত্ব নিতো এবং তাদের সঙ্গে থাকতো মুনিয়া তবে তার দুনিয়া এরকম হয়তো হতো না। মুনিয়া মারা গেছে, তার আত্মহত্যার মামলায় কি বিচার হবে জানি না, তবে এর মধ্যে আছে মুনিয়ার লোভী ভাই/বোন/দুলাভাই, তারা হয়তো লাভবান হবেন কিন্তু এই লাভবান হওয়া আসলে লাভবান হওয়া না, বেঁচে থাকা মুনিয়া ছিল আরো অনেক লাভজনক।
পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা আইন করে রাষ্ট্র ফিরিয়ে আনতে পারে না। রাষ্ট্র তো আইন করে দিয়েছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সন্তানের ওপর দিয়ে। কিন্তু কোনো বাপ-মা কি যাবেন ভরণ-পোষণ না দেওয়ার কারণে সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করতে? বরং সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে বৃদ্ধ মাকে দেখা যায় গোয়ালঘরে গরুর সাথে বসবাস করতে। আসলে এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের নিলে ভালো হয়। অনেক রাষ্ট্রই নিয়েছে। সক্ষমতা অর্জিত হলে হয়তো আমাদের রাষ্ট্রও নিবে।পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি আদেশ দিতে পারেন যা RESTRAINT ORDER নামে পরিচিত। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ৩০ ধারার অধীনে এ আদেশ লঙ্ঘন করার শাস্তি হচ্ছে অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। উক্ত শাস্তি ভোগ করার পর পুনরায় RESTRAINT ORDER লঙ্ঘন করার শাস্তি হচ্ছে ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। অর্থাৎ একবার শাস্তি ভোগ করার পর এরকম ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে, যেহেতু শাস্তি ভোগ করা হয়ে গেছে, সেহেতু পুনরায় পারিবারিক সহিংসতায় লিপ্ত হতে কোনো আইনি বাধা নেই। আইন সেক্ষেত্রেও ব্যবস্থা রেখেছে। পারিবারিক সহিংসতা রোধের লক্ষ্যে প্রতি বছর এ বিষয়ে একটি জরিপ হওয়া প্রয়োজন। ২০১৮ সালের প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, প্রায় ৭২% ভিকটিম নারী এ বিষয়টি প্রকাশ করে না। সারা দেশে এটা প্রচার হওয়া উচিত যে, পারিবারিক সহিংসতা যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন সেটাকে শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যাপারে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। বিষয়টিকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে সমাধান করা প্রয়োজন। আর যতদিন তা না হয় ততদিন পর্যন্ত সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো উচিত। আর মহসিন খানের মতো বিত্তশালীদের উচিত কোনো এক বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া যেখানে তাঁর নিঃসঙ্গতা দূর করার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।
আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী রয়েছে ডিপ্রেশন বা হতাশা। অনেকে বলে থাকে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হলে শুধু তারাই ডিপ্রেশনে ভোগে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত মতবাদ অনুযায়ী ডিপ্রেশন মূলত এক ধরনের মানুষিক রোগ যা সেই মানুষটির স্বাভাবিক জীবন কারণে বা অকারণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিনের ঝামেলা, মানুষিক আঘাত, অফিসের কাজের চাপ বা ব্যবসায়িক কাজের চাপের কারণে ডিপ্রেশন তৈরি হয়। এভাবে দীর্ঘদিন মানুষিক চাপে থাকতে থাকতে একসময় যখন অযথাই মানুষিক চাপ তৈরি হয় এবং তা থেকে নিজেকে মুক্ত করা অসাধ্য মনে হয় তখন এমন ডিপ্রেশন মূলত এক ধরনের মানুষিক রোগ। এমন মানুষিক রোগ থেকে নিরাময়ের জন্যে আশপাশের ঘনিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে অধিক সময় কাটানো প্রয়োজন।
আসুন আত্মহত্যা সম্পর্কিত আইন-কানুন জেনে রাখি। দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৩০৯ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করিবার উদ্যোগ করে এবং অনুরূপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে যাহার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। অপরদিকে, কোনো ব্যক্তিকে আত্মহত্যা করতে সহায়তা করিলে একই আইনের ৩০৬ ধারা মোতাবেক দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু ৩০৫ ধারা মোতাবেক আঠার বছরের কম বয়স্ক কোনো ব্যক্তি, কোনো উন্মাদ ব্যক্তি, কোনো বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি, কোনো জড় বুদ্ধির ব্যক্তি অথবা কোনো প্রমত্ততাগ্রস্ত ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে অনুরূপ আত্মহত্যা অনুষ্ঠানে সহায়তাকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে, কারাদণ্ডে বা অনধিক দশ বছরকাল মেয়াদি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে।
পরিশেষে এমিল ডুর্খেইমের আত্মহত্যার তত্ত্ব ছাড়াও তিনি আরও এক ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেন, তা হলো নিয়তিবাদী আত্মহত্যা (Fatalistic Suicide)। মহসিন খানের আত্মহত্যার বিষয়টিও এক ধরনের নিয়তিবাদী আত্মহত্যা (Fatalistic Suicide) বললে অত্যুক্তি হয় না। এ ধরনের আত্মহত্যর ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ হয়ে থাকে। নিয়ম-কানুনের অতি কড়াকড়িতে মানুষের জীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং নিজের জীবন হনন করে তখন তাকে নিয়তবাদী আত্মহত্যা বলে। যেমন দাস সমাজে দাসগণ অতিরিক্ত অত্যাচার-নিপীড়নে আত্মহত্যা করে। অতিরিক্ত শাসনে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে। মহসিন খান, মুনিয়া বা অন্য কেউ যখনই আত্মহত্যা করে তখনই একটু-আধটু লেখালেখি চলে। কিছুদিন পরপর টপিক হারিয়ে অন্য কোনো টপিকে কেউ লিখে আবার কেউ লিখে না। এভাবেই লেখালেখিরও আত্মহত্যা ঘটে আর মানুষের অগোচরে সব হারিয়ে যায়। কেউ আইন মানে আর কেউ বা মানে না। তবে নৈতিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটিয়ে ব্যক্তির ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানো যায় কি না ভেবে দেখা যায়। যেকোনো ধর্মীয় মূল্যবোধে যেহেতু আত্মহত্যা মহাপাপ তাই ধর্মের শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবনে আত্মহত্যা প্রতিরোধে চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?
বি.দ্র:লেখায় ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্তসহ সকল উৎসের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল।
লেখক: কলামিস্ট, কবি ও আইন গবেষক।