সব
facebook apsnews24.com
মৃত্যুদণ্ড কি এত সহজ? - APSNews24.Com

মৃত্যুদণ্ড কি এত সহজ?

মৃত্যুদণ্ড কি এত সহজ?

যে আদালতে কোন মামলার প্রথমে বিচার হয়, সে আদালতকে বিচারিক আদালত বলে। বিচারিক আদালতের রায় সাধারণত চূড়ান্ত রায় নয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেত্র বিশেষে ডেথ কনফার্মেশন, আপিল, রিভিশন এবং রিভিউয়ের মত কিছু উচ্চতর পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে। বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশনে যাওয়া যায়। তারপর হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে অ্যাপিলেট ডিভিশনে যাওয়া যায়। এই দুইটি ডিভিশনে হরহামেশা বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি খালাস পান বা সাঁজা কমে। আবার বিচারিক আদালতে খালাস পাওয়া আসামি দণ্ডিত হন। অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের রায় কখনোই চূড়ান্ত রায় নয়।
I repeat, এসব ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত রায় নয়। এই মামলায় আসামিপক্ষ যদি আপিল নাও করেন, তবুও হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক ডেথ কনফার্মেশন আবশ্যক। মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন মামলার যাবতীয় নথি এবং সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে কোন আবেদন ছাড়াই এই রায় পরিবর্তন করতে পারবে। তাছাড়া আপিল, রিভিশন, রিভিউয়ের মত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চতর বিষদ পর্যালোচনা সাপেক্ষ প্রক্রিয়া তো আছেই। তারপর বুঝা যায় আসলে আসামিদের ভাগ্যে চূড়ান্তভাবে কী আছে।

এবার আরেকটু টুইস্ট বাকি রইল। বিচারিক আদালত, তারপর হাইকোর্ট ডিভিশন, তারপর অ্যাপিলেট ডিভিশনে ১০-১৫-২০ বছর ঘুরে চূড়ান্ত রায়ে কোন ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেও এখানে গেম শেষ নয়।
এরপরে মূল কাজ নির্বাহী বিভাগের। অর্থাৎ, মামলার বিচারের পর নির্বাহী বিভাগ মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে ছেড়ে দিতে পারেন। নির্বাহী বিভাগের এই ক্ষমতা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সংবিধান, দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিধৃত হয়েছে। বিস্তারিত বিধানগুলো নিন্মে উল্লেখ করা হল-

১) কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যেকোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যেকোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে। [সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৯]

২) মৃত্যুদন্ড দান করা যেতে পারে এইরূপ প্রত্যেক ক্ষেত্রে সরকার অপরাধকারীর সম্মতি ব্যতিরেকেই উক্ত দণ্ডকে এই বিধি ও আইন বলে ব্যবস্থিত অন্য যেকোন স্বল্প দণ্ডে রূপান্তরিত করতে পারবেন। [দণ্ডবিধির ধারা ৫৪]। অর্থাৎ, আদালত মৃত্যুদণ্ড দেবার পর অপরাধীর আবেদন ছাড়াই সরকার স্বেচ্ছায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে যেকোন মেয়াদের কারাদণ্ডে হ্রাস করতে পারবেন।

৩) রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলে সরকার অপরাধীর সম্মতি ব্যতীতই দণ্ডাজ্ঞা হ্রাস করে অনূর্ধ্ব ২০ বৎসর মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে পরিবর্তন করতে পারবেন। [দণ্ডবিধির ধারা ৫৪]।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ হল অপরাধী যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন তিনি কারাগারে থাকবেন। সরকার এই শাস্তিকে কমাতে পারবেন। আর যদি কমান, তাহলে অবশ্যই ২০ বছরের বেশি মেয়াদে কারাগারে রাখবেন না। অর্থাৎ, যাবজ্জীন কারাদণ্ডকে কমিয়ে ২১ বছর, ৩০ বছর, ৪০ বছর ইত্যাদি কোন মেয়াদে করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে হ্রাস করলে অবশ্যই অনূর্ধ্ব ২০ বছরের কারাদণ্ড দিতে হবে।

৪) ৫৪ ধারা বা ৫৫ ধারার কোন বিধান দ্বারাই রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন, মৃত্যুদণ্ড মওকুফ বা স্থগিত করা বা দণ্ডাজ্ঞা হাসের অধিকার ক্ষুন্ন হবে না। [ একই আইনের ধারা ৫৫ক]

৫) কোন ব্যক্তি কোন অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোন সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয় সেই শর্তে তার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশ বিশেষ মওকুফ করতে পারবেন। [ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪০১(১)]

৬) সরকার দণ্ডিত ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই নিম্নলিখিত যে কোনটি রদবদল করে ইহার পরে উল্লিখিত যেকোন দণ্ড দিতে পারবেন-
মৃত্যুদণ্ড, যাবজীবন কারাদণ্ড, আসামী সে সময়ের জন্য দণ্ডিত হতে পারত তার অনধিক সময়ের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড, অনুরূপ মেয়াদের জন্য বিনাশ্রম কারাদণ্ড, জরিমানা।
এই ধারার কোন কিছুই দণ্ডবিধির ৫৪ অথবা ৫৫ ধারার বিধানাবলীকে প্রভাবিত করবে না। [ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪০২]

৭) সরকারকে ৪০১ ও ৪০২ ধারায় যে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে তা মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টও প্রয়োগ করতে পারবেন। [একই আইনের ধারা ৪০২ক]

দণ্ড মওকুফ বা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা সরকার যেখান থেকেই আসুক, মূল সিদ্ধান্ত হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]

২০১৪ সালের ৬ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- ২০১৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২৬ জন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামির সাজা মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। (তথ্যসূত্র- https://www.prothomalo.com/bangladesh/২৬-জনের-ফাঁসির-দণ্ড-মওকুফ-রাষ্ট্রপতির )

আবার, ২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর একদিনেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ২০ জন ফাঁসির আসামির সাজা মওকুফ করেন। (তথ্যসূত্র- https://www.banglanews24.com/cat/news/bd/272425.details )

এবার চলুন দেখা যাক- প্র‍য়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান থেকে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ পর্যন্ত মেয়াদে মৃত্যুদণ্ড মওকুফের ৭ টি ঘটনাঃ

১) ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সাত ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ সেই মামলার অন্যতম ফাঁসির আসামি ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান৷ এ কারণে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছিলেন৷ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে শফিউল আলম প্রধানের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাফ করে দেন৷ পরে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি বা জাগপা গঠন করেছিলেন শফিউল আলম প্রধান৷ ২০১৭ সালে তিনি মারা যান৷

২) পুরান ঢাকার দুই ব্যবসায়ীকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি আবুল কাসেম মানিককে ক্ষমা করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ।

৩) পুরান ঢাকার দুই ব্যবসায়ী হত্যা মামলায় ফাঁসি হওয়া আসামিদের একজন ছিলেন মহিউদ্দিন জিন্টু৷ বিদেশে পালিয়ে থেকে ২০০৫ সালে দেশে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন৷ তারপর রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তাকে ক্ষমা করে দেন৷ জানা যায়, পালিয়ে গিয়ে তিনি সুইডেনে ছিলেন৷ সেখান বিএনপির সুইডেন শাখার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন জিন্টু৷

৪) একসঙ্গে ২০ জনকে ক্ষমাঃ
নাটোরে ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকারের ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা যুবদল নেতা সাব্বির আহম্মদ গামাকে হত্যা করা হয়৷ ঐ মামলায় ২০০৬ সালে ২১ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়৷ ২০১০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ২০ জনকে ক্ষমা করে দেন৷ একজন আসামি পলাতক ছিলেন৷

৫) ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদকে জানান, গত পাঁচ বছরে ২৬ জন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামির সাজা মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি৷ এদের একজন লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছেলে এএইচএম বিপ্লব৷ ২০০০ সালে লক্ষ্মীপুর বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ২০০৩ সালে তার বিরুদ্ধে এই রায় হয়৷ ২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করেন৷ পরে আরেক হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা কমিয়ে ১০ বছর করা হয়৷ ২০১৮ সালে তিনি মুক্ত হন৷

৬) ফরিদপুরের আসলাম ফকির ২০০৩ সালে এ কে এম সাহেদ আলীকে হত্যা করেন৷ সেজন্য তার মৃত্যুদণ্ড হয়৷ ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগের দিন তিনি এমন আচরণ শুরু করেন, কারাগারের নথির ভাষায় যা ছিল ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’৷ ফলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয়৷ ২০১৫ সালে তার প্রাণভিক্ষার আবেদন গ্রহণ করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৭ সালে তিনি মুক্তি পান৷ গতবছর আবারও এক হত্যা মামলার প্রধান আসামি হন তিনি৷

৭) ১৯৯৬ সালে ফ্রিডম পার্টির নেতা মোস্তফা হত্যা মামলায় ২০০৪ সালে জোসেফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ঢাকার জজ আদালত৷ ২০১৫ সালে আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়৷ এরপর ২০১৮ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ক্ষমা পেয়ে তিনি মুক্তি পান৷ সেই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘তিনি আবেদন করেছিলেন ভয়ানক অসুস্থ, তার এক কিংবা দেড় বছর বাকি ছিল সাজা ভোগের৷ সেটার জন্য তিনি মারসি পিটশন করেছিলেন৷’’
(তথ্যসূত্র- www.dw.com, date: 09/02/2021, ডাইরেক্ট লিংক প্রথম কমেন্টে দেয়া হয়েছে)

১৯৯১ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি ছিল। তখন এসব ক্ষমতার চর্চা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে হত। ১৯৯১ থেকে সরকার পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়ে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু হয়েছে, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রপতি একটি মাত্র ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছামত কাজ করতে পারেন, তা হল প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]

আদালতের কাজ হল কে দোষী আর কে নির্দোষ তা বলে দেয়া এবং আইনসম্মত কোন সাঁজার আদেশ দেয়া। আর তাকে বাস্তবে কী শাস্তি দেয়া হবে বা না হবে– তা চূড়ান্তভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। কাজেই অতীত দৃষ্টান্তের আলোকে বলা যায়- আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হবে তা দেখতে হলে সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক- মতিউর রহমান, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj