সব
facebook apsnews24.com
নারী-পুরুষের যৌন অধিকারে বৈষম্যমূলক আইন বনাম বাস্তবতা! - APSNews24.Com

নারী-পুরুষের যৌন অধিকারে বৈষম্যমূলক আইন বনাম বাস্তবতা!

নারী-পুরুষের যৌন অধিকারে বৈষম্যমূলক আইন বনাম বাস্তবতা!

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

একজন নারী যে কারও সাথে যে কোনও ধরণের যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। নারীর এ যৌনতায় আইনে কোথাও কোনও বাঁধা নেই। নারীকে দÐ দেওয়ার কোন বিধানও বাংলাদেশের আইনে নেই। আবার পুরুষের ক্ষেত্রেও যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আইনগত কোন বাঁধা নেই। বলা আছে, যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক কুমারী, বিধবা এবং বিবাহ বিচ্ছেদে একা হয়ে যাওয়া নারীর সাথে সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। নারী-পুরুষের এ যৌনতায় আইনে বাঁধা নেই কিন্তু সমাজে বাঁধা আছে, ধর্মে বাঁধা আছে, লালিত মনস্তত্ত¡ ও মূল্যবোধে বাঁধা আছে। সেকারণ, সমাজে যৌনতার চৌর্যবৃত্তি অনেক বেশি। তবে পৃথিবীর অনেক দেশেই নর-নারীর যৌন সম্পর্ক একেবারেই জৈবিক, স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ব্যাপার। সেখানে যৌনতা মানুষের মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত।

পৃথিবীর সকল দেশেই যৌনতার সীমানা সেখানকার আইন, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক বোধের দ্বারা নির্ধারিত। তবে সীমানাটি কোথাও বিস্তৃত, কোথাও সংকীর্ণ। যৌনতার ক্ষেত্রে অতি প্রাচীনকাল থেকে গড়ে ওঠা একটি সীমানা হচ্ছে বিয়ে। যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেয়ের বয়স ১৮ আর ছেলের বয়স ২১ আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় ১৬ বছর বয়স যে কোন মেয়ের বিবাহের জন্য বিবেচনাযোগ্য একটি বয়স। পাশাপাশি ১৬-১৮ বছর বয়সের নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌন মিলনকে এ আইন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।

কোনও পুরুষ যদি ১৪ বছর কিংবা ১৪’র অধিক বয়সের কোনও নারীর সাথে (পারস্পরিক সম্মতিতে) যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তাকে দÐবিধি অনুযায়ী ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে না। তবে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে। কারণ ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও নারী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি দিতে পারে না। দÐবিধির ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী স্ত্রী ব্যাতিত ১৪ বৎসরের কম বয়স্ক কোনও নারীর সাথে তার সন্মতিক্রমেও যৌনকর্ম করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হয়।

উপরের দুটি আইন বিশ্লেষণে আমরা যা পাই তাহলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সম্মতি দেবার বয়স ১৬ বছর। আর দÐবিধি অনুযায়ী ১৪ বছর বয়স পূর্ণ হলে একটি মেয়ে কোনও পুরুষকে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সম্মতি দিতে পারে। অথচ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী নারীর ১৮ বছরের আগে বিয়ে করার অধিকার নেই।

একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। আমাদের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। আবার ২৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে। এদিকে ১৮ বছর বয়সী যে কোন নারী পুরুষ সাবালক-সাবলিকা হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম উঠছে এবং তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন, নিজের মতামত প্রকাশ করছেন। অথচ জীবন সঙ্গী নির্বাচনে পুরুষের বয়স হতে হচ্ছে ২১ বৎসর।

দÐবিধির ৪৯৭ ধারায় বিয়ের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য ব্যাভিচারকে দুস্কর্ম এবং অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, “কোনও লোক যদি, অপর কোনও নারীর স্বামীর বিনা সম্মতিতে যৌনসঙ্গম করে, এরূপ যৌনসঙ্গম ধর্ষণের অপরাধ না হলে, সে লোক ব্যাভিচার করেছে বলে পরিগণিত হবে। এর জন্য ওই পুরুষকে যেকোনও বর্ণনার কারাদÐে (যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে) বা জরিমানা দÐে বা উভয় দÐে শাস্তিযোগ্য হবে। এরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটির পরকীয়া কিংবা দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে না”। পরকীয়ার অপরাধ শুধু পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়। আবার নারী যদি অবিবাহিতা বা বিধবা হয় তাহলে পুরুষও কোনও শাস্তি পায় না। কারণ এক্ষেত্রে মামলার বাদী হওয়ার মত কেউ থাকেনা।

তবে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট বলেছেন, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না যে, তারা ব্যাভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)।

দÐবিধি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের মধ্যে বিয়ের বয়স নিয়ে বিরোধ আছে। এ বিরোধের ফলে একটি মেয়েকে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন, প্রেমঘটিত কারণে কোনও কিশোরী যদি অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া তার প্রেমিককে বিয়ে করে তবে মেয়ের অভিভাবক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উক্ত প্রেমিক এবং তার অভিভাবকদের বিরুদ্ধে অপহরণ বা ধর্ষণ অথবা উভয় ধরনের মামলা করে এ অজুহাতে যে, তাদের মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। বয়স প্রমাণের জন্য কোনও সনদপত্রের আইনগত বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা ও এর প্রয়োগ নেই বিধায় মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্কও হয় তবুও এ ধরনের মামলা করার সুযোগ আছে। মামলা হবার পর মেয়েটিকে নিয়ে তার অভিভাবক, পুলিশ এবং তার প্রেমিক পক্ষের লোকজনদের মধ্যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়। এর পরিণতিতে মেয়েটিকে প্রায়শঃ নিরাপদ হেফাজতের নামে জেলখানায় যেতে হয়।

স্বেচ্ছায় বাল্যবিবাহকারী কিংবা বাল্যবিবাহের শিকার একটি মেয়ে যতকাল প্রাপ্তবয়স্কা না হবে তত কাল তাকে নিরাপত্তা হেফাজতের জন্য জেলে রাখার আদেশ দিতে পারে আদালত। এর ফলে হাজার হাজার মেয়ে দিনের পর দিন জেল খাটছে। আবার পুরুষের বিয়ে করার অধিকার তৈরি হয় ২১ বছরে। তবে কম বয়সে বিয়ে করলেও ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষকে জেলে থাকতে হয় না। অথচ অল্প বয়সে কোনও মেয়ের বিয়ে হলে যতদিন না তার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয় ততদিন সেই মেয়েটিকে জেলে থাকতে হয়। মানুষ এখানে আইন মানতে চায় না। কিন্তু সমাজ বাস্তবতাকে মানে। ধর্মীয় বিশ্বাস বলছে, তুমি যদি যৌনতা চাও তবে বিয়ে কর। বয়স কোনও বিষয় নয়। সুরা নিসা বলছে ‘ শিশুরা যখন স্বপ্নে বীর্যপাত করে তখন তাদের শৈশব অতিক্রম করে সাবালকের সীমায় পৌছে যায়।’

আমাদের আইন, রাষ্ট্র, সংবিধান ও সামাজিক আচরণে আজব সব বৈপরীত্য! পৃথিবীর তাবৎ সহানুভূতি ঢেলে দেওয়া হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতি; সাহিত্যে, কলায়, রসবোধে, জীবনের সর্বত্র কিশোর প্রেমকে উপজীব্য করা হচ্ছে; তরুণ মনস্তত্ব ও মূল্যবোধকে প্রেমের প্রতি সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ নরনারীর প্রেমবোধের বিজ্ঞানকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইনে মানুষকে বেঁধে ফেলার উপকার ও অপকারের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার জন্য আইনজ্ঞ বিজ্ঞজনদের প্রতি অনুরোধ রইল।

সবিশেষ রাষ্ট্রযন্ত্রের সমীপে নিবেদন এই, যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন মানুষকে স্বাধীনতা বঞ্চিত করে, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক নারী-পুরুষের অধিকার ও সুবিধা-অসুবিধা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। কাজেই মানবিকতার দিক দিয়ে হলেও এ আইনের শীঘ্রই সংশোধনের প্রয়োজন। খুব অবাক হই, আমরা কীভাবে মানবিকতা ভুলতে বসেছি। একুশ শতকের দোরগোড়ায় যেখানে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে মহাকাশেও পা বাড়িয়েছি, সেখানে আজও নারী-পুরুষের অধিকার, তাদের ইচ্ছাকে বেঁধে রেখে দিয়েছি। যৌনতাকে এখনও আমরা মানবিকতার চোখে দেখি না, এটা খুবই কঠোর বাস্তব।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj