সব
facebook apsnews24.com
আইন-আদালত ধনী, গরীব সকলের! তাই নয় কি? - APSNews24.Com

আইন-আদালত ধনী, গরীব সকলের! তাই নয় কি?

আইন-আদালত ধনী, গরীব সকলের! তাই নয় কি?

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

যুগে যুগে মনীষী, পন্ডিত, দার্শণিকগণ সমাজ, সংস্কৃতি থেকে নিয়ে জীবন ঘনিষ্ঠ অনেক বক্তব্য দিয়ে গেছেন, যেগুলোকে আমরা বাণী চিরন্তনী বলে জানি। বিখ্যাত দার্শনিক সলোন বলেছেন ‘আইন মাকড়াশার জালের মত, ক্ষুদ্র কেউ পরলে আটকে যায়, বড়োরা ছিড়ে বেড়িয়ে আসে।’ আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘আমরা সবাই পাপী; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে; অন্যের পাপ মাপি।’

দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনাটি ছিল, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে বনানী থানায় মামলা হওয়া। মামলাটি তদন্ত করে ওই বছরের ৮ জুন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনের ছেলে শাফাত আহমেদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জন্মদিনের পার্টির কথা বলে রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন শাফাত ও তাঁর বন্ধু নাঈম আশরাফ।

আলোচিত বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় শীর্ষ ধনীর সন্তানেরা বৃহষ্পতিবার খালাস পেয়েছেন। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ খালাস আদেশ লিখেছেন। খালাস পাওয়া পাঁচ আসামি হলেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনের ছেলে শাফাত আহমেদ, শাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ, শাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন। পাঁচ আসামির খালাসের রায় শোনার পর দুই ধর্ষিতার কান্নায় এখন আকাশে বাতাসে ভাসছে।

অদালত পাঁচ আসামিকে খালাস দেওয়ার আদেশে এমন কিছু পর্যবেক্ষণ, উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন যা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন ধর্ষণের ঘটনার ৩৮ দিন পর কেন মামলা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরে আদালত রায়ে বলেছেন, ধর্ষণ মামলা প্রমাণ করতে হলে মেডিকেল প্রতিবেদন খুব জরুরি। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীর পরিহিত বস্ত্রের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনও গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলায় দুটি প্রতিবেদনেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

অথচ আমি একজন আইনজীবী হিসেবে উপলব্ধি করেছি, ধর্ষণের মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায় না, কেননা মামলা হয়তো করা হয় অপরাধ ঘটার অনেক পরে বা আলামতগুলো হয়তো জানার ঘাটতির কারণে ভিকটিম নষ্ট করে ফেলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের সময় অপরাধী নিজেও ডিএনএ নমুনাগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারে বা আলামত নষ্ট করার জন্য ভিকটিমকে বাধ্য করতে পারে। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ একটি জটিল বিষয়ও বটে। সঠিকভাবে না করা গেলে ডিএনএ নমুনা দূষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাতে ফলাফল সঠিক আসবে না। সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী ব্যক্তির দক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিএনএ-সংক্রান্ত তথ্যের ওপর যেকোনো ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে এবং এ কারণেই ২০১৪ সালের ডিএনএ আইনে ভিকটিম ও অভিযুক্ত ব্যক্তি দুজনেরই সম্মতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্মতি না থাকলে আদালতের কাছ থেকে অনুমতি আনলেও তাকে সম্মতি ধরা হবে না। ভিকটিম যখন জানবেন এ তথ্য বিবাদীপক্ষের কাছে যেতে পারে, উন্মুক্ত আদালতেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। কাজেই ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হওয়ার ঘটনায় ধর্ষিতাদের মেডিকেল রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে, এটা জানার জন্য আইনবিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।

রায়ে বলা হয়, মামলার আসামি নাঈম আশরাফ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে তাঁর জবানবন্দির তথ্য মামলার সাক্ষ্য ও মেডিকেল প্রতিবেদনকে সমর্থন করে না। তাঁর দেওয়া জবানবন্দি অসত্য। জবানবন্দি দেওয়ার আগে সাত দিন তিনি পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা স্বেচ্ছায় দেননি, আদালতে লিখিত দরখাস্ত দিয়ে বলেছিলেন আসামি নাঈম আশরাফ। অপর আসামিদের জবানবন্দিকে আইনের পরিভাষায় স্বীকারোক্তি বলার সুযোগ নেই। কারণ, তাঁরা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে কোনো বক্তব্য দেননি।

রায়ে আরও বলা হয়, মামলার আসামি শাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার সঙ্গে শত্রæতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা থানায় বসে থেকে এই মামলা করান।

ভবিষ্যতে সঠিক তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুলিশ যেন মামলা গ্রহণ না করেন, সে ব্যাপারেও রায়ে বলা হয়।তা ছাড়া, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। এ জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন আদালত।

ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা না নিতে আদালত পুলিশকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা সস্পূর্ণ এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়। এক ধরনের আইন বহির্ভূত, অপ্রত্যাশিত কথাবার্তা। ‘অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ কখন মামলা নেবে তার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া নেই। নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মামলা বহু বছর পর নেয়া হয়েছে। এটা সিভিল মামলা নয়, ফৌজদারী মামলা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সব নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। তারা কত বছর পরে বিচার পেয়েছিলেন-সেটা নিশ্চয়ই ওই বিচারকের জানার কথা।

একটি কেইস স্টাডি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। খুলনায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অপরাধে স্থানীয় ট্রাইব্যুনাল আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, সঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আসামি হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আসামির সাজা বহাল রেখে আবেদনটি খারিজ করে দেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, ধর্ষণ মামলায় মেডিক্যাল রিপোর্ট মুখ্য নয়, ভুক্তভোগীর মৌখিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার ভিত্তিতে আসামিকে সাজা প্রদান করা যেতে পারে।

ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করানোর বিষয় তুলে ধরে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল ঘটনা ঘটে। আর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন ওই বছরের ১৭ মে। অর্থাৎ ৩২ দিন পর। যদি ভিকটিমকে ওইদিনই (যেদিন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেয়) ডাক্তারি পরীক্ষা করাও হতো, তবুও দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা করার কারণে ধর্ষণের কোনো আলামত না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না করার কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের মামলা অপ্রমাণিত বলে গণ্য হবে না। সেইসাথে ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলেও তা মিথ্যা নয় বলেও রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। Email: seraj.pramanik@gmail.com,, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj