অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান
জামিনের উৎপত্তিঃ (Origin of Bail)
প্রত্যেকটি ফৌজদারি মামলায় জামিনের বিষয়টি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। জামিন সংক্রান্ত আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামিন(Bail) শব্দটি ল্যাটিন Bajulare শব্দের সহিত সম্পর্কযুক্ত। Bajulare শব্দের অর্থ ভার বহন করা বা দায়িত্ব বহন করা। তাহা হইলে ইহা মনে করা খুবই স্বাভাবিক যে, আইন আদালতে ব্যবহৃত Bail(জামিন) শব্দটি ল্যাটিন Bajulare শব্দ হইতে আসিয়াছে। কারন,কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটককারী পুলিশ অফিসার কিংবা আদালত সাময়িকভাবে মুক্তি দিলে পূনর্বার নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে হাজির হইবার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তাহার দায়িত্বভার অন্য একজনকে বহন করিতে হয়।
জামিনের সংজ্ঞাঃ (Definition of Bail)
১৮৯৮ সালের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডে জামিনের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয় নাই।তবে সাধারনভাবে জামিন বলতে আমরা বুঝি নির্দেশ মোতাবেক বা চাহিবামাত্র কোন লোককে কোন নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে হাজির করিবার বা টাকা পয়সা বা জিনিসপত্র চাহিবা মাত্র ফেরত প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান। কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির জন্য এই মর্মে নিশ্চয়তা বিধান করেন যে, তাহাকে নির্দিষ্ট সময়ে ও স্থানে হাজির করিবেন। আবার কেহ কোন জিনিস বা টাকা পয়সা গ্রহন করিলে অন্য একজন নিশ্চয়তা বিধান করেন যে, গ্রহনকারী ফেরত না দিলে, তিনি নিজে উহা ফেরত দিতে বাধ্য থাকিবেন। এই ধরনের বিধানকে জামিন বলা হয় এবং যিনি এই নিশ্চয়তা বিধান প্রদান করেন তাহাকে জামিনদার বলা হয়।
১৮৯৮ সালের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডে জামিনের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা না হইলেও জামিনের বিধান ফৌজদারি এবং কতিপয় ক্ষেত্রে বিশেষ আইনের অন্তর্নিহিত বিষয়। কারন এই বিধিতে এবং বিশেষ আইন আদালতে জামিন সম্পর্কিত বিধান বিধিবদ্ধ করা হইয়াছে। কে জামিন পাইতে পারে এবং কোন কোন অপরাধের ক্ষেত্রে পেতে পারে এই সকল কিছু পদ্ধতিগত ব্যাপার মাত্র ,যাহা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড ও বিশেষ আইনগুলিতে আস্থা পাইতে পারি। ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ৩৯ অধ্যায়ে যে জামিনের কথা বলা হইয়াছে তাহা শুধু গ্রেফতারকৃত বা কারারুদ্ধ বা আদালতের পরোয়ানার কারনে আদালতে হাজির হওয়া যে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন সাধারন অভিধান ও আইন সম্বন্ধীয় অভিধানে যে সংজ্ঞা পাওয়া যায় তাহাতে জামিন হইল গ্রেফ্তারকৃত বা কারারুদ্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়া এবং নির্দিষ্ট দিনে,নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে তাহাকে বা তাহাদেরকে হাজির করাইবার নিমিত্তে গৃহীত ও প্রদত্ত নিশ্চয়তা।
Oxford Dictionary-তে জামিন (Bail) সম্পের্ক বলা হয়েছে যে- Bail Means a security for the appearance of prisoner on giving which the accused is released pending trial.
Encyclopedia of Britannica-য় জামিনের (Bail) যে সংজ্ঞা প্রদান করা হইয়াছে তাহা হইলঃ Bail means the freeing of setting at liberty of one arrestees or imprisoned person by action, either Civil or criminal, on surety taken for his appearance on a certain day and at a placed named. The surety is termed bail because the person arrested is imprisoned is placed in the custody of those who bind themselves or become bail for his due appearance when required.
জামিন (Bail) এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মহামান্য ফেডারেল কোর্ট বলেনঃ “Bail is released of a person from the custody of police and delivery in to the hands of sureties who undertake to produce him in court whenever required to do so ( 5 DLR-143)”
জামিন মঞ্জুরের মূলনীতিঃ (Principle of Granting Bail)
প্রত্যেকটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংবিধান দ্বারা নিশ্চয়তা বিধান করা হইয়াছে। কোন ব্যক্তির জামিন মঞ্জুরের ব্যাপারে তাঁহার স্বাধীনতার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডে আইন বিধিবদ্ধ করা হইয়াছে এবং বহু মামলায় উপমহাদেশের মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টগুলি ইহার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। সেকারনে জামিন মঞ্জুরে বা মঞ্জুর করিতে অস্বীকার করনের ব্যাপারে সকল কিছু গভীরভাবে পরীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। এমন কোন গানিতিক নীতি নাই যাহার উপর ভিত্তি করিয়া আদালত জামিন মঞ্জুর করেন বা মঞ্জুর করিতে অস্বীকার করেন। তাই প্রত্যেক মামলায় আগত আবেদন উহার নিজস্ব ঘটনা ও অবস্থার উপর নির্ভর করিয়া নিষ্পত্তি করিতে হয়। আদালত যদি সন্তুষ্ট হন যে ,জামিন মঞ্জুর করিলে আসামি বিচারে অংশ গ্রহন করিবে,পলায়ন করিবে না এবং স্বাক্ষ্যে অবৈধ হস্তক্ষেপ করিবেনা তাহা হইলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করিতে হয়। তাই ইন্ডিয়ার মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেন,- In principle the indination should be infavour of bail and not jail.
জামিন পদ্ধিতগত একটি সুবিধা মাত্র। তবে এই সুবিধা বিভিন্ন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জামিন মঞ্জুর না হওয়া পর্যন্ত কোন আসামি ইহা অধিকার হিসাবে দাবি করতে পারে না।যদিও বলা হয় যে জামিনেযাগ্য অপরাধ আসামির একটি অধিকার। জামিন মঞ্জুরের সুবিধা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড এবং কোন বিশেষ আইন আসামিকে দিয়ে থাকে। জামিনের মূলনীতি হচ্ছে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিকে নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে হাজির করিবার শর্তে জামিনদারের হেফাজতে প্রদান করা। আইনের মূলনীতি এই যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে নির্দোষ বলিয়া গন্য করিতে হইবে। এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন হইবার জন্য জামিনদারের মুচলেকায় কোন আসামিকে জামিনে মুক্তি দিবার আদেশ দিতে হয়।যেহেতু অভিযুক্ত হইলেই কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না,সেইহেতু গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত না হইলে কাহারো জামিন অস্বীকার করিয়া তাহার স্বাধীনতা খর্ব করা উচিত নহে।জামিনের আবেদন বিচারকের বুদ্ধি বিবেচনার তীক্ষ্ণতা দিয়া নিষ্পত্তি করিতে হয় । প্রত্যেকটি ঘটনা সম্পূর্ণরুপে স্বতন্ত্র। সেকারনে ঘটনার গুরুত্ব ,পরিধি, ঘটনার সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনিয়া জামিনের আবেদন নিষ্পত্তি করিতে হয়,অর্থাৎ জামিন মঞ্জুর করিতে হয় বা মঞ্জুর অস্বীকার করিতে হয়। আসামি হইলেই যে তিনি তর্কিত অপরাধ করিয়াছেন এই ধারনা পোষন করা ঠিক নহে। তবে আসামি যদি জামিন অযোগ্য অপরাধের জন্য অভিযুক্ত না হন তাহা হইলে তিনি অতি সহজেই জামিন পাইতে পারেন এবং আইন তাহার জামিন পাইবার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনা বরং অনুমতি দেয়। তবে সেই ক্ষেত্রেও মুচলেকা দিবার বিধান রাখা হইয়াছে।
আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বৈধ স্বাক্ষের দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত তাহাকে নির্দোষ বলিয়া গন্য করিতে হইবে। এই কারনে জামিন বা মুচলেকার মাধ্যমে জামিনের বিধান রাখা হইয়াছে যাহাতে আসামিকে বিচারের সময় আদালতের সামনে হাজির পাওয়া যায়। আসামিকে জামিনে মুক্তি দেবার অর্থ হইল পুলিশ বা আদালতের হেফাজত হইতে অন্যের হেফাজতে দেওয়া যিনি নির্দেশিত দিনে, সময়ে ও স্থানে আসামিকে হাজির করিতে সক্ষম হইবেন। জামিন মঞ্জুর কিংবা মঞ্জুর না করিবার ক্ষেত্রে আইন বিজ্ঞ আদালতকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেছে। এই ক্ষমতা বিজ্ঞ আদালতের সুবিবেচনার উপর অধিক নির্ভরশীল। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া বিজ্ঞ আদালত মামলার যেকোন পর্যায়ে আসামিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন এমনকি দন্ডিত ব্যক্তিকেও কোন কোন ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আপিল আদালত জামিনে মুক্তি দিতে পার। আইনের নীতি হিসাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ের বিজ্ঞ আদালতে জামিনের আবেদন করিতে হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে যে আদালত পরোয়ানা ইস্যু করেন উক্ত পরোয়ানার উত্তর প্রদানের মধ্যেই সেই বিজ্ঞ আদালতে জামিনের আবেদন করা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে সেই আদালত জামিন মঞ্জুর করিতে অস্বীকার করিলে তখনই পরবর্তীতে উচ্চতর আদালতে উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে পৃথক মিস কেস করিয়া জামিনের আবেদন করিতে হয়।
কিভাবে জামিনের আবদন করিতে হয়? (How do make an application of Bail?)
কোন ব্যক্তি যখন গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতীত পুলিশ অফিসার কর্তৃক আটক হন বা গ্রেফতার হন তখন উক্ত পুলিশ অফিসারের হেফাজতে থাকাবস্থায় তিনি উক্ত অফিসারের নিকটে জামিনের আবেদন করিতে পারেন।যদি কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার পূর্বক বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয় অথবা তিনি নিজে পরোয়ানা মূলে হাজির হন তাহা হইলে তিনি নিজে অথবা নিয়োজিত বিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন মঞ্জুরের জন্য বিজ্ঞ আদালতে আবেদন করিতে পারেন। ইহা ছাড়াও কারাগারে আটক ব্যক্তিও কারাগারে থাকাবস্থায় অথবা তাহাকে আদালতে হাজির করা হইলে তখন তিনি বিজ্ঞ আদালতে জামিনের আবেদন করিতে পারেন।জামিনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই আবেদন করিতে হয় অর্থাৎ তাহাকে আবেদনপত্রে দস্তখত বা টিপসিহ প্রদান করিতে হয়।কারাগারে আটক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ওকালতনামায় আবেদনকারীর স্বাক্ষরসহ কর্তৃপক্ষের প্রতিস্বাক্ষর লইতে হয়। যে সকল গ্রাউন্ডস বা কারণগুলির উপর ভিত্তি করিয়া বা যে কারনগুলি দেখাইয়া আবদন করিতে হয় তাহা আবেদনপত্রে বা হলফনামায় পরিষ্কার ভাবে দরখাস্তে উল্লেখ করিতে হয়। আবেদনপত্রে কোন আদালতের প্রতি আক্রমনাত্বক ভাষা ব্যবহার করা বা অসম্মানজনক কোন শব্দ ব্যবহার করা উচিৎ নহে। আবেদনে বর্ণিত কারনগুলি বিজ্ঞ আদালতের কাছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করিতে হয়,যাহাতে বিজ্ঞ আদালত দাখিলকৃত আবেদন হইতে পরিষ্কার ধারনা লইতে পারেন।আবেদনে কোন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উপস্থাপন করা উচিৎ নহে। আবেদনপত্রটিতে মূল কেসটি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করিতে হয়।আবেদনের উপরে আদালতের নাম,মামলার ক্রমিক নম্বর প্রদান পুর্বক আসামির নাম-ধাম উল্লেখ করিতে হয়। অতঃপর ক্রমিক দিয়া জামিন পাইবার কারনগুলি বা হেতুসমূহ উল্লেখ করিতে হয়। আবেদনপত্রটি সাধারনতঃ কম্পিউটার টাইপ করে দিলে ভাল হয়। এই ব্যবস্থার সুযোগ না থাকিলে পাঠযোগ্য পরিষ্কার হাতের লেখাযুক্ত আবেদন করিতে হয়।জামিনের আবেদনে যুক্তিতর্ক সর্ম্পকিত কোন বিষয় এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কোন রুলিংস উল্লেখ করিতে নাই। আবেদনপত্র উপস্থাপনের সময় বা শুনানির সময় যুক্তি প্রদর্শন কালে যে কোন প্রকার রুলিংস বিজ্ঞ আদালতের সামনে তুলে ধরা যায়।
কোথায় বা কাহার নিকট জামিনের আবেদন করিতে হয়ঃ where the bail application is be submitted?
আইন বিধি নিষেধ না থাকিলে সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতে জামিনের আবেদন করিতে হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, যে আদালত পরোয়ানা ইস্যু করেন উহার উত্তর দানের জন্যই সেই আদালতে জামিনের আবেদন করিতে হয়। প্রথমেই দেখিতে হইবে যে, জামিন মঞ্জুর কিরবার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট আদালতের আছে কি না? যদি থাকে তাহা হইলে সেই আদালতে জামিনের আবেদন করিতে হইবে।কোন মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হইলে উক্ত ট্রাইব্যুনালেই প্রথম জামিনের আবেদন করিতে হইবে। চলবে———-
লেখকঃ অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, মেহেরপুর, E-mail:mizanmpur06@gmail.com