এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
চলচ্চিত্র শিল্পী পরী মনি’র গ্রেফতার ও তিন দফায় রিমান্ড নেয়ার বিষয়ে আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। সরগম হয়ে উঠেছে চায়ের দোকান থেকে খোদ সুধী মহলে। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক। তবে আমার আজকের লেখার বিষয় ভিন্ন।
সাংবিধানিক অধিকার হলো কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনারকর দন্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সঙ্গে কোনোরুপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না কিংবা কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কাজ করা যাবে না। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, সে সংবিধান লংঘন করে পুলিশ কি কারও সাথে যথেচ্ছা করার অধিকার রাখে?
রিমান্ডে নিয়ে কি কান্ড ঘটে তার একটি আইনী কৌতুক উপস্থাপন করলে পাঠকের মাঝে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। জাতিসংঘের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দেন। তার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর বৃটেনের একজন করে পুলিশ কর্মকর্তাও যোগ দেন। তাদের প্রশিক্ষনের একটি অংশ ছিল আমাজান বনে। এ বনের মধ্যে কয়েকটি হরিণের বাচ্চা ছেড়ে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের বলা হয় যে, এ বাচ্চাগুলোকে খুঁজে বের করে আনতে হবে। সময় দেয়া হবে একদিন। তবে এর বেশী সময় লাগলেও হরিণের বাচ্চা ছাড়া খালি হাতে ফেরা যাবেনা। সুইজারল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হরিণের বাচ্চা উদ্ধার করে ফিরলেন। ফ্রান্সের পুলিশ হরিণের বাচ্চা নিয়ে হাজির হন তিন দিন পর। বৃটেনের কর্মকর্তা সাত দিন পর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ১৫ দিন পর। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশের কর্মকর্তার কোন খোঁজ নেই। প্রশিক্ষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। একমাস পর ব্রাজিলের বিভিন্ন শহর থেকে ঘুরে ফিরে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকরা প্রশ্ন করলেন, ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসলেন কেন? জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে বলেছে এটা ছাগলের বাচ্চা। একে রিমান্ডে দেন। দেখবেন পরদিন এটা নিজেই স্বীকার করবে যে সে একটা হরিণের বাচ্চা।
অথচ আমাদের সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ২৫ ও ২৬ ধারা মোতাবেক ‘কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন অবস্থায় দোষ স্বীকার করলে এটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না।’ তাহলে কেন এই রিমান্ড?
পাঠক আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে একদা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার স্ত্রী বিদিশার বিরুদ্ধে একটা মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল। সেই মামলায় গুলশান থানার পুলিশ বিদিশাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে হাজতে পুরে দেয়। চূড়ান্ত বিচারিক রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সেই মামলায় গ্রেফতারের শুরুতেই থানা হাজতে বিদিশাকে কীভাবে ঢুকানো হয়েছিল, তা তার নিজ বয়ানেই ‘শত্রুর সাথে বসবাস’ বইয়ে প্রকাশ করেছেন।
“….হঠাৎ পেছন থেকে ওসি নূরে আলমের হুংকার, ‘ঢুকাও, এক্ষুণি ঢুকাও। এতক্ষণ ঢুকাও নাই ক্যান? ঢুকাও। কিসের ভিআইপি, কিসের সিআইপি। খানকি মাগির জন্য আবার এত সম্মান কী! লাইত্থাইয়া ঢুকাও ভিতরে’।
….প্রথমে মনে হলো ওরা বোধকরি আমার পতন ঠেকানোর জন্য ওড়না টেনে ধরেছে। কিন্তু সে ভুল ভাঙলো মুহূর্ত পরেই। দেখলাম, ওই অবস্থাতেই দু’দিক দিয়ে আমাকে টানছে ওরা। একদল সামনের দিকে, আর একজন (পেছন দিক থেকে) ওড়না ধরে রেখেছে। আমার দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো, জিভ বের হয়ে গেল। আমি নড়তে পারছি না। এরই মধ্যে একজন লোক মোটা একটা লাঠি দিয়ে গায়ের জোরে মারলো আমার তলপেটে। ….তলপেটে বাড়ি খেয়ে কোমর থেকে নিচের অংশটা অবশ হয়ে গেল। একটা বস্তার মতো পড়ে গেলাম মাটিতে। তখনও আমার জ্ঞান ছিল কিছুটা। মাটিতে পড়ে যেতেই শুরু হলো আমার উপর বুটের লাথি। বুক পিঠ মাথা পেট- শরীরের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে পড়েনি সেই বুটের আঘাত। তবে তলপেট এবং এর আশেপাশের সংবেদনশীল এলাকার প্রতিই যেন তাদের আগ্রহটা ছিল বেশি। …আমি জ্ঞান হারালাম।
….কয়েক মুহূর্ত পরই সামান্য সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরলো। টের পেলাম আমাকে টেনে-হিঁচড়ে ওসির রুম থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সে অবস্থায়ও চলছে বেধড়ক মার। আবার জ্ঞান হারালাম আমি”।
হাজত বাসের পর আদালতে আনীত হলে, আদালত বিদিশার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে পুলিশের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে রিমান্ডে থাকাকালীন সময়ে বিদিশার অভিজ্ঞতা তার বয়ানেই শোনা যাক–
“….কে একজন ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘মহিলা তো একই কথা বলছে! এই যাও বরফ নিয়ে আসো। বরফ ঢুকাও। সব (কথা) বের হয়ে যাবে’। এই কথাগুলো কি জসিম বললো? আমি তখন তাকাতে পারছি না, তবে কন্ঠস্বরে সেই রকমই মনে হলো।
বরফ দিয়ে কী হবে? কোথায় ঢোকাবে?
আমার শরীর আগুনের মতো জ্বলছিল। মনে হলো, বরফ হলে হয়তো একটু ঠান্ডা হবে।
….দু’টো বলিষ্ঠ হাত আমার দুই কাঁধ চেপে ধরল। পায়ের দিকেও হাতের স্পর্শ পেলাম। স্কার্ট পরা ছিলাম বলে কোন প্রকার বাঁধা ছাড়াই পা বেয়ে সেই হাত উঠতে থাকলো উপরের দিকে সরীসৃপের মতো। ….কেউ একজন বললো, ‘মহিলার বোধহয় গরম লাগছে। উপরের পার্টটাও খুলে দাও’। ….বলা হচ্ছিল, ভালভাবে খুঁটিনাটি ভিডিও করার জন্য। তারপর ক্যাসেটটি কা’কে যেন পাঠানোর কথাও বলা হলো। হাসতে হাসতে একজন বললো, ‘কে বলবে তিন সন্তানের মা। যে ফিগার! তিনি এই ক্যাসেট দেখে খুশিই হবেন’। আমি জানি না কে এই ‘তিনি’। নারীত্বের চরম অপমান দর্শনে যিনি খুশি হন, কল্পনা করতে পারি না কেমন মানব সন্তান তিনি।….হঠাৎ আজানের শব্দ শুনলাম। জোহরের নামাজের আজান ছিল বোধহয় সেটা। ….দু’জন বাদে আর সবাই চলে গেল নামাজ পড়তে।
…রাতে আমাকে আবার নেয়া হলো বারিধারায়, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের সামনে। ….জিজ্ঞাসাবাদের নামে পৈশাচিক নির্যাতন। রাতের নির্যাতনের সময় এক পর্যায়ে মনে হলো, দুপুরেই বুঝি ভাল ছিল। ….সেসব বলে পাঠকদেরকে আর ক্লান্ত করতে চাই না। কেবল একটুকু বলবো, অতি সাধারণ অনেক ঘটনার একটি ছিল আমার হাতের নখ উপড়ে ফেলা”।
পাঠক! একটা মোবাইল ফোন চুরির মামলায় বিদিশাকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তার আর্থ-সামাজিক অবস্থান ছিল বাংলাদেশের উচ্চতম পর্যায়ে। সে নিজে একজন কোটিপতি, দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী। এরশাদের স্ত্রী হিসেবে এবং তার পাশাপাশি কয়েক বছর রাজনীতি করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশের হোমরা-চোমরা এবং দেশে বসবাসরত বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে তার সখ্যতা ছিল, ওঠা-বসা ছিল। তার উপর সে বৃটেনের নাগরিক। তবুও, তার বিরুদ্ধে একটি মোবাইল ফোন চুরির মতো একটি হাস্যকর অভিযোগের মামলা পুলিশ লুফে নিয়েছিল। এর অন্যতম কারণটি হচ্ছে- ভদ্রগোছের তরুণী নারীর নগ্ন দেহকে তছনছ করে পুলিশের পৈশাচিক আনন্দ পাবার বর্বরোচিত লালসা। এটা বাংলাদেশ, পুলিশের ঐতিহ্য।
নারীদেহকে তছনছ করার পুলিশের এই বর্বরোচিত লালসায় কোথায় সেই কথিত নারী নেত্রী, মানবাধিকারকর্মী আর এনজিও’র নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে আরাম-আয়েশে দিনাতিপাত করা মানুষগুলো?
পাঠক নিশ্চয়ই রুবেলকে পিটিয়ে হত্যার কথা সবার মনে আছে। শামীম রেজা রুবেল ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁকে নির্যাতন করা হয়। মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। রুবেলের মৃত্যুর ঘটনা তখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সরকার এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। হত্যার অভিযোগে ওইসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। অন্যদিকে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনা ও সুপারিশ দিয়ে রায় দেন। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরামহীন প্রচেষ্টার পরও সরকার আজ পর্যন্ত ওই রায়ের আলোকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি কিংবা করতে পারেননি। অবশেষে ২০১৬ সালে এপ্রিল মাস থেকে আপীল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়, অভিমত ও নির্দেশনা বহাল রেখেছেন। কোনো ব্যক্তিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।’ জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারী পরীক্ষা করাতে হবে। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। আইনে এসব কথা বলা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘রিমান্ড নিয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮