নূরুন্নবী সবুজ
আপনি কোন কারনে মনে করলেন আপনার মানহানি হয়েছে আর তাই মানহানির মামলা করবেন। এক্ষেত্রে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি ক্ষতিপূরণে চান নাকি তার শাস্তি নিশ্চিত করতে চান। অন্যভাবে বললে যার দ্বারা মানহানির স্বিকার হয়েছেন বলে মনে করেন তাকে যদি জেলের ভাত খাওয়াতে চান তাহলে এক পদ্ধতি আর তার কাছ থেকে যদি মান সম্মান বাবদ ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা চান তাহলে অন্যভাবে মামলা করতে হবে।
মানহানির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করলে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হবে। এই ক্ষতিপূরণ দাবী করার টাকার পরিমাণের উপর নির্ভর করে আপনি কোন দেওয়ানী আদালতে মামলা করবেন। আর আপনার টাকার পরিমাণের উপর নির্ভর করে মূল্যানুপাতে কোর্ট ফি প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে বিবাদীর শাস্তি নয় বরং টাকা পরিশোধ করতে হবে।
২য় ক্ষেত্রে আপনি যদি জেলের ভাত খাওয়াতে চান তাহলে ফেীজদারী আদালতে মামলা করতে হবে। দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি কখন হবে ও কখন হবে না সে সমন্ধে বলা আছে। এই শর্ত গুলো পূরণ হলে মামলা করা যাবে।
মানহানি হতে পারে,
১, চিহ্নের মাধ্যমে
২ কথার মাধ্যমে
৩, দৃশ্যমান কল্পস্মৃতির সাহায্যে
৪, বা এরুপ কোন বিষয়াদীর সাহায্য নিয়ে ইত্যাদি।
তবে এই বিষয়গুলো মাধ্যমে কোন ব্যক্তির সুনাম বা সামাজিক মর্যাদার ক্ষতি হতে হবে বা ক্ষতি হতে পারে এমন সম্ভাবনা থাকতে হবে। দুইজন ব্যাক্তি যখন নিজেদের ভেতর কোন বিষয় নিয়ে কোন গোপন আলাপ করছে তখন তাদের ভেতর নানা অজানা বিষয় আলোচনায় আসতে পারে। এই বিষয়গুলো যখন কারো পক্ষ থেকে ৩য় কোন ব্যক্তি বা ব্যাক্তিবর্গকে বলা হয় তখন তা স্বাভাবিক ভাবে মানহানি করার সম্ভাবনা তৈরী করে। এমন ঘটনা ঘটলে মানহানির মামলা করা যায়।
৪৯৯ ধারায় এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যা আমরা মানহানির পর্যায়ে দেখি না। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পরও যদি তার নামে কোন নিন্দা করা হয় আর সে বেচে থাকলে যদি তা মানহানি হতো তাহলে মৃত ব্যাক্তির নামে তা বললেও মানহানি হবে। তাই কোন মৃত ব্যাক্তির নামেও নিন্দা ছড়ানো অপরাধ। নিদৃর্ষ্ট কোন ব্যাক্তির নামে নিন্দাবাদ যেমন মানহানি হবে তেমন কোন ব্যাক্তি সমষ্টি, সংগঠন বা সংঘের নামে নিন্দা ছড়ালেও তা মানহানি হবে।আরো বিশেষ ভাবে যে কথাটি এখানে আছ তা হলো কেউ যদি পরোক্ষভাবে কাউকে বা কারো বিরুদ্ধে নিন্দা ছড়ায় তাহলে সেটাও মানহানি হতে পারে। আমরা অনেক বিদ্রুপাত্মক লেখা বা কথা শুনে থাকি যে গুলোও ধারার ব্যাখার আলোকে মানহানির পর্যায়ে পড়ে বা কারো মানহানি হয়েছে বলে মনে হলে সে মামলা করতে পারে।
কিছু কিছু ঘটনা মানহানির পর্যায়ে পড়বে না । দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারাতে সেই কথাগুলোই বলা হয়েছে।
যে কারনগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে,
১. জনগণের জন্য সত্য দোষারোপ করা । যেমন বর্তমান সময়ে ত্রাণ চুরির বিষয়টি। এমন বিষয়গুলো জনগণের সামনে সত্য উন্মোচন করে বলে তা মানহানির পর্যায়ে পড়তে নাও পারে।
২. জনগণের প্রতি সরকারী কর্মচারীর আচরণ। যেমন, পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে এসে যদি তার বাড়ি ঘর ভাংচুর করে তা প্রকাশ করা মানহানির পর্যায়ে নাও পড়তে পরে।
৩. কোন গণ সমস্যা সম্পর্কে কোন ব্যাক্তির আচরণ। যেমন অনেক এলাকায় বিদ্যুত সমস্যা, গ্যাস সমস্যা সহ নানা সমস্যা আছে । এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে বা কোন ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে তার সত্যতার প্রকাশ করা মানহানি হবে না। আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কাজ করলে বা অনুষ্ঠানে সভাপতি ইত্যাদি হলে সে কাজও মানহানি হবে না।
৪. আদালেতের কার্যক্রমের প্রতিবেদন বা রিপোর্ট পেশ করা। আদালতে নানা তথ্য প্রমাণের উপর নির্ভর করে বিচার কাজ চালানো হয়। এই রিপোর্ট প্রকাশ মানহানির পর্যায়ে পড়বে না।
৫. আদালতে সিদ্ধান্তকৃত মোকদ্দমার দোষ গুণ বা সাক্ষী সহ অন্যদের আচরণ প্রকাশ। আদলতে যে মামলাগুলো পরিচালিত হয় তা কিছু নিয়ম মেনে হয়। এর সাথে জড়িয়ে থাকে সাক্ষীর সাক্ষ্য সহ নানা তথ্য উপাত্ত । আর এগুলো জনস্বার্থে প্রকাশ মানহানি নয়।
৬. গণ-অনুষ্ঠানের গুণাবলী। অনুষ্ঠান বা নানা প্রোগাম নানা সময়ে হয়ে থাকে। যখন কোন প্রোগ্রাম কোন ব্যাক্তি কতৃক তৈরী করা হয় তখন প্রোগ্রামটি তার দ্বারা ভালো না খারাপ হয়েছে সে সমন্ধে মন্তব্য করা যাবে। সহজ কথায় যে ডেকোরেশনের বা সাজানোর কাজটি করেছে তার সমালোচনা করা মানহানি না।
৭. আইনসংগত ক্ষমতা বিশিষ্ট ব্যাক্তি মাধ্যমে নিন্দা। অনেক সময় গ্রাম্য শালিসে কোন ব্যাক্তির সত্যতা তুলে ধরার জন্য নানা কথা বলা হয়ে থাকে । যখন এরুপ নিন্দাগুলো কোন আইনগত ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যাক্তি করেন তা মানহানি নয়।
৮. ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যাক্তির সরল বিশ্বাসে অভিযোগ উত্থাপন: আদালতে সাধারনত দেখা যায় বিবাদী পক্ষের উকিল অভিযুক্তের দোষ ধরার মাধ্যমে কথা বলা শুরু করে । এরুপ কাজ মানহানির পর্যায়ে পড়বে না।
৯. নিজের বা অন্যের স্বার্থ রক্ষার্থে কারো সমন্ধে দোষ প্রকাশ করা। বাড়ির মালিক তার ছেলেকে কিছু টাকা দিয়ে রহিম নামে এক ব্যাক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললো সে টাকা চুরি করতে পারে তার থেকে টাকা সামলে রাখবে । এমন কাজ মানহানি নয়।
১০. কোন ব্যাক্তিকে যখন তার মঙ্গলে সতর্ক করা হয়। যেমন, রহিমকে বলা হলো ক’ নামের গ্রামটির ভেতর দিয়ে যাবার সময় সাবধানে যেতে। কেননা সে গ্রামে ছিনতাই ও চুরির ঘটনা খুব। এমন সতর্কতা তৈরী মানহানি নয়।
মানহানির ব্যাতিক্রম সহ আমাদের মানহানির মামলা করার গ্রাউন্ডস পরিস্কার হওয়া চাই। শুধু মাত্র ব্যাক্তিগত আক্রোশ যেন মানহানির মামলার কারন না হয়।
মানহানি মামলার শাস্তি কি হবে তা দন্ডবিধির ৫০০ নং ধারায় বলা আছে। মানহানি করেছে প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ দুই বছরের শাস্তি বা অর্থদন্ড বা আদালত মনে করলে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড একসাথে দিতে পারে।
৫০১ ধারায় যে ব্যাক্তি মানহানি হবে জেনেও কোন মুদ্রন বা খোদাই করে সেটাও অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। যদি এমন কাজ কেউ করে তবে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের শাস্তি বা অর্থদন্ড বা আদালত মনে করলে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড একসাথে দিতে পারে।
৫০১ ধারায় তৈরীকৃত বিষয় বা বস্তু যদি মানহানি হবে জেনে বিক্রি করে তাহলে সেটাও অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। যদি এরুপ হয় তবে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের শাস্তি বা অর্থদন্ড বা আদালত মনে করলে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড একসাথে দিতে পারে।
মানহানির ৩ ধরনের বিষয়বস্তুর কথা বলা হলেও তাদের একই ধরণের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মানহানির বিধান অবশ্যই দরকার আছে কিন্তু এই বিধানের অপব্যবহার না করে যেন সঠিক গ্রাউন্ডস নিয়ে মামলা করা হয় ও দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় সে দিকেও আমাদের নজর রাখতে হবে।
নূরুন্নবী সবুজ, আইন বিশ্লেষক ও কলামিষ্ট।, mdnurunnobiislam379@gmail.com, 01517856010
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।