এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: ২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট একটি মামলায় রায় প্রদানকালে লিখেছেন, প্রতিটি চিকিৎসক মানুষের অপারেশন করার সময় তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু অপারেশনে নিয়োজিত করে থাকেন। কেননা তিনি জানেন তাঁর মনোযোগের সামান্যতম বিঘ্ন ঘটলে রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। ঠিক তেমনি বিজ্ঞ বিচারকরা যদি বিচার বিভাগ স্বাধীনতার নামে উদাসীন হয়ে পড়েন, তাহলে বিচারকার্য অবিচারে পর্যবসিত হতে পারে। ফলাফল হিসেবে বিচারক সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সুদূর প্রসারিভাবে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ অপরিসীম ক্ষতির স্বীকার হতে পারেন।
ধর্ষণ মামলায় ভুল আইনে একজন বিচারক বিচার করায় ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে রাষ্ট্রের। যদিও আপিল বিভাগ ১০ সপ্তাহের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া এ আদেশ স্থগিত করেছেন। ১২ আগস্ট’২০২১ আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের চেম্বারজজ আদালত এ স্থগিতাদেশ দেন। সেইসঙ্গে আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০০১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিবেশীর পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে ‘প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের’ অভিযোগে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় জলিলের বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালের ৩০ অগাস্ট ওই মামলায় ভোলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জলিলকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদ- দেয়।। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে জেল আপিল করেন জলিল। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ জলিলের যাবজ্জীবন সাজা বাতিল করে মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য বিচারিক আদালতে পাঠায়। কারণ অপরাধ সংগঠনের সময় জলিল নাবালক (শিশু) ছিল। অভিযোগপত্র জমার সময় তার বয়স ছিল ১৬ বছর। ওই সময়ে কার্যকর শিশু আইনে ১৬ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবেই ধরা হত। কিন্তু শিশু আইনের বদলে জলিলের বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কিন্তু হাইকোর্টের ওই দিকনির্দেশনার পরেও জলিলকে বিচারের ক্ষেত্রে শিশু আইনের কোনো বিধান প্রতিপালন করা হয়নি। ভোলা জেলা দায়রা জজ আদালত কর্তৃক জুবেনাইল কোর্ট গঠন করার সত্ত্বেও চিলড্রেন অ্যাক্ট ৭৪ এর বিধান প্রতিপালন করা হয়নি। তাতে জলিলকে শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিচার করে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে জলিল বিচারের বদলে অবিচারের শিকার হয়েছেন। সেকারন মহামান্য হাইকোর্ট জলিলের দ-াদেশ বাতিল করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে-২০০১ সালে ১৩ নভেম্বর থেকে আজ অবধি আবদুল জলিলকে ১৪ বছর জেলহাজতে আটক রেখে তার জীবনের যে ক্ষতি করা হয়েছে, তা পূরণ হবে কীভাবে? ওই জেল আপিল নিষ্পত্তি করে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর রায় দেন হাইকোর্টের বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের একক বেঞ্চ। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ২৫ মে ওই রায় প্রকাশ হয়। ওই রায়ে হাই কোর্ট ‘ভুল আইনে’ বিচার করায় আব্দুল জলিলকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়।
বিচারিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নির্বাহী ও আইনসভা থেকে প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন বিচারিক কাঠামো নিয়ে অনেকদিন ধরে দাবী চলে আসছে। অসদাচরণের জন্য বিচারকদের জবাবদিহির মুখোমুখি করতে বিশ্বে স্বাধীন জুডিশিয়াল কাউন্সিল রয়েছে। নাগরিক হিসেবে বিচারকেরও আপিল ও রিভিউ করার অধিকার আছে। কারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইনি ব্যবস্থায় সংবিধান, আইনি মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যক্তি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতে আসেন। বিচারক সংবিধান ও আইনের অধীনে তা নিষ্পত্তি করেন। বিচারকেরা মানুষ, কেউ অনিয়ম করলে বা ঘুষ নেওয়া ও দুর্নীতির মতো ফৌজদারি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকলে কে তাদের মূল্যায়ন করবে?
বিচার বিভাগ সংবিধান ও আইন দিয়ে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। সমাজ, আইন ও সংবিধানের কাছে জবাবদিহি করবে এবং এটি নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকের কোনো সিদ্ধান্ত তাঁর ঊর্ধ্বতন আদালতেও পুনর্বিবেচনা হয়। অন্যদিকে সংবিধানের বিধান অনুসারে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিষয় তদারক করেন হাইকোর্ট। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ-সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়েও এটি আছে। অথচ তদারকির ক্ষেত্রে বড় কিছু বাঁধা আছে, নিয়ন্ত্রণ এখনো অনেকাংশে নির্বাহীদের আওতায়। সংবিধান বলেছে, একজন বিচারকের ‘গুরুতর অসদাচরণ’ পাওয়া গেলে তাঁকে অপসারণ করা যাবে।
যদিও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া মামলার রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচারকরা কারও দাস নয় এবং কেউই তাদের মনিব নয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি লিখেছেন, বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা আইন, সংবিধান ও জনগণের কাছে। বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। এ ধরনের জবাবদিহিতার প্রশ্নই ওঠে না।
পৃথিবীর অন্যন্য দেশের মতো বিচারপতিদের জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতা থাকা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ভারতের জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে বিচারপতিদের জবাবদিহিতায় কোনো বাঁধা দেয়নি। বিচারপতিরাও গর্ববোধ করেন যে, তারা আর কারও কাছে নয়, জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করেন। আর কোনো বিচারক যদি মনে করেন, তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতার তুলনায় যথেষ্ট বড়, তবে তিনি বিচার বিভাগে স্বাগত নয়। তার সরে যাওয়াই উচিত।
যদিও আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিরা স্বাধীন থাকবেন। ১১৬(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগে নিয়োজিত সব ব্যক্তি এবং বিচার পরিচালনাকালে সব ম্যাজিস্ট্রেট স্বাধীনতা ভোগ করবেন। জবাবদিহিতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা উচিৎ। জনগণ ও গণমাধ্যম বিচারপতিদের সমালোচনা নিয়ে আইনী বাঁধা থাকার কথা নয়।
যদিও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে তিনি তিনটি বিভাগের কাজের ধরন ব্যাখ্যা দেন এভাবে- নির্বাহী বিভাগ স্টিয়ারিং হুইল নিয়ন্ত্রণ করে। দেশ কিভাবে চলবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় এ বিভাগ। আইন বিভাগ জ্বালানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। নির্বাহী বিভাগের প্রস্তাব অনুসারে অর্থ সরবরাহের নীতি প্রণয়ন করে এ বিভাগ। বিচার বিভাগের হাতে থাকে ব্রেকের নিয়ন্ত্রণ। যদিও তিনি লিখেছেন, বিচারপতিরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে অবশ্যই। ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিলে পুরো প্রতিষ্ঠানের ওপর তার কালো ছায়া পড়ে। কাজেই জনগণের জন্য বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত রাখলে এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
বিচারপতি ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, কেউ কেউ মনে করেন বিচারপতিরা একই সঙ্গে স্বাধীন এবং চরমভাবে জবাবদিহির মধ্যে থাকতে পারেন না। এমনকি ব্যাখ্যামূলক জবাবদিহিতাও বিচারিক স্বাধীনতার জন্য মানানসই নয় বা বিপজ্জনক। লর্ড কুক বলেছেন, বিচারপতিদের জবাবদিহিতা হবে মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণ। অন্যথায় বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা বিপন্ন হতে পারে।
তিনি আরও লিখেছেন, বিচারপতিরা উন্মুক্ত আদালতে বসেন। তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। বিচার বিভাগ তাদের কাজের মূল্যায়ন করে। তারা সিদ্ধান্তের জন্য কারণ ব্যাখ্যা করতে আইনত বাধ্য। তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করা হয়। আইনগত কারণে তাদের কর্তৃপক্ষ সরিয়ে দিতে পারে। তারা সহকর্মীদের কাছে জবাবদিহি করেন। দায়মুক্তি সংস্কৃতি নির্মূল করা, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নতুন সমাজ নির্মাণ এবং ব্যক্তির মানবাধিকারের প্রতি সম্মানের জন্য বিচারিক জবাবদিহি দরকার।
তবে কোন কোন বিচারক শত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেই বিচারিক ক্ষমতা গণমানুষের জন্য প্রয়োগ করেন আবার কেউ নিজ ও নিজ পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেন। কেউ ঝুঁকি গ্রহণ করেন, কেউ তাঁবেদারিতে তুষ্ট থাকেন। কারো নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে, কেউ দালালির খাতায় নাম লেখান অথবা ‘যেমনি চালাও তেমনি চলি’ এ মনোভাব নিয়ে গা ভাসিয়ে দেখে না দেখার ভান করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে, আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন।
কেউ চোখবুজে অন্যায়-অবিচার হজম করেন, কেউ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কারো মেরুদ- সোজা রাখেন, আবার কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কারো মেরুদ- এমনিতে নেতিয়ে যায়, এটা নির্ভর করে নির্দিষ্ট ব্যক্তির মানসিকতা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের ওপর। কাকের মতো কেউ চোখবুজে নিজেকে আড়াল করে, কেউ বাঘের মতো তীক্ষè দৃষ্টিতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো নিজ কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পরম শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী যদি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ প্রত্যাখ্যান না করতেন, তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে আরো বেশি রক্তের প্রয়োজন হতো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ভূমিকা স্বাধীনতা আন্দোলনকে যেমন ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি বিচার বিভাগের সম্মানকেও করেছে গৌরবোজ্জ্বল। তবে বিচার বিভাগের কলঙ্কজনক ইতিহাসও রয়েছে, যার গণিত পরিমাণ কম নয়।
গণহারে প্রতি থানায় সিরিজ আকারে গায়েবি মামলা, যার মধ্যে মৃত, হজ পালনের জন্য বা অন্য কোনো কারণে বিদেশে অবস্থানকারী মানুষও বাদ যাচ্ছে। বিকৃত রুচির ধর্ষকেরা যেমন বয়সের বাছ-বিচার করে না, তেমনি ৮৫-৯০ বছরের বৃদ্ধ, যারা দীর্ঘ দিন রোগশয্যায় মৃত্যুর দিন গুনছেন, তারাও গায়েবি বোমা মামলার আসামি থেকে বাদ পড়ছে না। মামলার আসামি করলেও পুলিশের লাভ, ধরলেও লাভ, ছাড়লেও লাভ, রিমান্ডে নিতে পারলে আরো বেশি লাভ, ক্রসফায়ারের ভয়ে কাবু করতে পারলে আরো অধিকতর লাভ, অধিকন্তু রয়েছে হাইকোর্ট কর্তৃক জামিন লাভের পর একটার পর একটা জেলগেটে গ্রেফতার-বাণিজ্য, যা খুবই মুনাফাভিত্তিক।
প্রধান বিচারপতির কাছে সরাসরি অভিযোগ দায়ের করার রেওয়াজ বা নজির পৃথিবীতে রয়েছে। একজন কিশোরী ভারতের প্রধান বিচারপতিকে পোস্ট কার্ডে একটি চিঠি দিয়েছিল, সে চিঠি আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিলÑ এ কথা প্রধান বিচারপতি নিশ্চয়ই জানেন। সরকার আইন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করায় দেশে পুলিশি রামরাজত্বের অবসান হবে কি না জানি না। তবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ মর্মে জনগণকে রক্ষা করার কোনো কর্তব্য ও দায়িত্ব যদি থেকে থাকে প্রধান বিচারপতির, যিনি সংবিধানকে প্রটেকশন করাসহ ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ গ্রহণ করেছেন এবং সর্বপ্রকার ভয়ভীতি, অনুরাগ ব্যতিরেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের শপথও তার রয়েছে। সংবিধান ও আইন দিয়ে যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাবান। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ভার বিচারপতিদের ওপরও পড়ে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন গবেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com