এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আমাদের সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে, বোনেরা বাবার পৈত্রিক ভিটার অংশ পায় না আবার বাপের বাড়ির সম্পত্তি ভাগ নিলে স্বামীর সংসারে অভাব অনটন নেমে আসে। আবার অনেকে বলে থাকে ভাইদের সাথে বোনদের সম্পর্কের অবনতি এবং বোনেরা ভাইদের বাড়িতে এবং ছেলেমেয়েরা মামার বাড়িতে যাবার অধিকার বঞ্চিত হয়। ভাইয়েরা বোনকে ফাঁকি দিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে ভোগ-দখল করলে যদি অভিশপ্ত না হয়, সম্পর্ক অবনতি না হয়, তো বোনদের অপরাধ কোথায়?
বোনদের প্রাপ্য সম্পত্তি ভাই ভোগদখল করবে, ফুফুর সম্পত্তি ভাইপো ভোগদখল করবে, তাতে অপরাধ হবে না, অথচ পিতামাতার সম্পত্তির বৈধ অংশ কন্যা ভোগদখল করলেই ‘অভিশপ্ত’ হবে। প্রকৃতপক্ষে মেয়েদের স্থায়ীভাবে ঠকানোর এগুলো একটি চতুর কৌশল ছাড়া আর কিছুই না। শুধু বোনের প্রাপ্ত অংশই নয়, যদি কোন বোন তার স্বামীর অব্যাহত অত্যাচারে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, তাহলে ভাই ভরণপোষণ দেবে। জোর করে বোনের ভরণ পোষণের ভয়ে উপযুক্ত সুরাহা ছাড়া ওই স্বামীর বাড়িতে পৌঁছে দিবেন না। কাজেই বোনের উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার অধিকার দিয়ে দাও…।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করে, যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকারী সম্পত্তি নিয়ে পলায়ন করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন।’
একটি উদাহরণ দিলেই আজকের আলোচ্য বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। রহিমরা চার ভাই ও এক বোন। রহিমের বাবা মারা গেছেন। তাঁর মা বেঁচে আছেন। এখন রহিমরা চার ভাই মিলে বাবার সম্পত্তি নিজেদের নামে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। ভাইয়েরা কিছুতেই বোনের বাবার সম্পত্তির অংশ দিতে চাচ্ছেন না। এখন বোন কি করবেন?
মুসলিম আইনে বাবা বা মা মারা গেলে মৃত ব্যক্তির যদি ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই থাকে তাহলে রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে ছেলেরা যা পাবেন, মেয়ে বা মেয়েরা তার অর্ধেক পাবেন। অর্থাৎ ভাইয়েরা ইচ্ছা করলেই বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে বোনের বিয়ে হোক বা না হোক, সেটি বিবেচ্য নয়। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত বোনেরা বাঁটোয়ারা বা বণ্টনের মোকাদ্দমা করতে পারেন। মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ-বণ্টন নিয়ে উত্তরাধিকারীদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হলে- বাঁটোয়ারা মামলা করে অধিকার ফিরে পাওয়া যায়। এই মোকদ্দমা চলাকালে কেউ মারা গেলে তাঁদের উত্তরাধিকারীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এবং অংশ চাইতে পারেন। অর্থাৎ শুধু বোনেরা নন, বোনেরা মারা যাওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকারীরাও এই মামলায় পক্ষ হতে পারেন।
এ মামলায় দুবার ডিক্রি হয়। প্রাথমিক ডিক্রি হওয়ার পরে বা আগে নিজেদের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার সুযোগ আছে। প্রাথমিক ডিক্রির পর বণ্টন না করা হলে আদালত অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ করে অংশ নির্ধারণ করে দিতে পারেন এবং চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদান করেন। এছাড়া বোনদের ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট ও নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা যেতে পারে। ভয়-ভীতি-হুমকি ও জীবননাশের আশঙ্কায় আদালতে ফৌজদারি মামলাও করা যায়।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮