সব
facebook apsnews24.com
রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল নেতৃত্ব নির্বাচনে কেন্দ্রের মতই গুরুত্ব দিতে হবে। - APSNews24.Com

রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল নেতৃত্ব নির্বাচনে কেন্দ্রের মতই গুরুত্ব দিতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল নেতৃত্ব নির্বাচনে কেন্দ্রের মতই গুরুত্ব দিতে হবে।

রায়হান কাওসার

সহজ অর্থে তৃণমূল বলতে তৃণের মূল বা উদ্ভিদের গোড়াকে বোঝায়। মূল একটি গাছের প্রাণ। এই মূলকে কেন্দ্র করেই একটি গাছ তার কান্ড ও শাখা-প্রশাখাকে ঊর্ধ্ব আকাশে বিস্তৃত করে প্রতিনিয়ত। শুধু রোদ আর হাওয়া খেয়ে একটি গাছ বেঁচে থাকতে পারেনা। মূলের মাধ্যমে একটি গাছ মাটি হতে পানি শোষণ করে নিজেকে সজীব রাখে। মূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেই সূর্যের তাপ এবং হাওয়া গাছটিকে দ্রুত শুকিয়ে গৃহিনীর চূলার জন্য প্রস্তুত করে ফেলে। এছাড়া মূলই একটি গাছকে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে। গাছের মূল যেমন একটি গাছের নিকট অতি প্রয়োজনীয়, ঠিক তেমনই তৃণমূলের রাজনীতি একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক রাজনীতি এবং সাধারণ জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তৃণমূলকে বলা যেতে পারে একজন সফল রাজনীতিবীদের জননী। জননী যেমন তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়, তেমনি তৃণমূলই একজন সাধারণ মানুষকে নেতায় পরিণত করে তোলে। করে তোলে বিখ্যাত, বানায় ক্ষমতাধর এমপি-মন্ত্রী। অনেক সময়, একটি দেশের শ্রেষ্ঠতম নেতৃত্বও বেরিয়ে আসে এই তৃণমূল বা সাধারণ জনগণের মধ্য থেকে। প্রকৃতপক্ষে, যোগ্য তৃণমূল নেতৃত্ব নির্বাচিত করতে না পারলে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের জন্য প্রকৃত সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক সময় ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ঠিকই, কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে এসে সেগুলি ভালভাবে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে, যোগ্য তৃণমূল না থাকলে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কল্যাণকর সিদ্ধান্তগুলির সুফল, সকল সময় সঠিকভাবে সাধারণ জনগণের মাঝে পৌছাবে- সেটি বলা কঠিন। করোনা কালীন সময়ে তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্রদের মাঝে সরকারি ত্রাণ ও সাহায্য পৌছানো নিয়ে যে অনিয়ম বা অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে- তা অনেক পত্রিকাতেই আমরা লক্ষ করেছি। কেউ কেউ তেল চুরি করে খাটের নীচে রেখে দিয়েছেন কিংবা কেউ ত্রাণের মাল বাড়িতে নিয়ে এসে লুকিয়ে রেখেছেন। দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের অনেক নেতৃবৃন্দ অল্প কিছু সরকারি সুযোগ-সুবিধার লোভ সামলাতে পারছেন না। এ সকল ঘটনা প্রকৃতপক্ষে তৃণমূল নেতৃত্ব নিয়ে আরেকটু ভাববারই ইঙ্গিত দেয় এবং ইঙ্গিত দেয় তৃণমূল নেতৃত্ব নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আরেকটু বিচার-বিশ্লেষণ করার।

তৃণমূল রাজনীতিতে কয়েক ধরণের লোক বিদ্যমান থাকে। নিবেদিতপ্রাণ স্থানীয় নেতৃত্ব- তাদের মধ্যে একটি। এই মানুষগুলোকে বলা যেতে পারে তৃণমূল রাজনীতির প্রাণ। এরাই একটি রাজনৈতিক দলকে মাঠ পর্যায়ে টিকিয়ে রাখেন। এই লোকগুলো কিছুটা একরোখা ও অভিমানী প্রকৃতির হয়ে থাকে। অবশ্য, ভাল করে বোঝালে দলের প্রয়োজনে যে কোন সময় তাঁরা কলুর বলদের মত খাটতে প্রস্তুত থাকেন। দলের জন্য নিজেদের সবটুকু দিয়ে দলকে বিজয়ী করার চেষ্টা করেন। এই প্রকৃতির লোকজন মূলত দলের মূল নেতৃত্বকেই অনুসরণ করে থাকে। স্থানীয় কোন নেতা কী বলল, সেটা নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামান না। সাধারণ ভোটারদের নিকট নাম-কাওয়াস্তে অনেক নেতার চেয়ে নিবেদিতপ্রাণ এ সকল স্থানীয় নেতৃবৃন্দের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে।

তৃণমূলে প্রভাব বিস্তারকারী কিছু শীর্ষ নেতৃবৃন্দও থাকেন যারা সংসদে কিংবা উপজেলায় স্থান নিতে চান। সংসদে যেতে আগ্রহী- এমন নেতৃবৃন্দই এই ক্যাটাগরিতে পড়েন। একজন নির্বাচিত সাংসদের নেতৃত্বের জন্য এই লোকগুলি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। এই লোকগুলির সাথে একজন সাংসদ সঠিকভাবে সমন্বয় করতে না পারলে তাঁর নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখাও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তৃণমূল রাজনীতিতে থাকেন কিছু চালাক প্রকৃতির রাজনীতিবীদগণও। সংসারে খুব বেশি অভাব থাকে না এদের। ফলে রাজনীতিতে ব্যয় করার জন্য যথেষ্ট সময় থাকে হাতে। দলের স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবীদদের সাথে যুক্ত থেকে নানা বিষয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন তাঁরা। দল থেকে কিংবা সরকার থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকলে হাতছাড়া করবেন- এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না তাঁদের কাছ থেকে।

শহর এলাকার মত গ্রামেও রয়েছে কিছু শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য মানুষ। এ সকল শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য মানুষদের নিকট থেকে গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলি বুদ্ধি-পরামর্শ নিয়ে থাকেন, তাঁদের আলোচনা দ্বারা প্রভাবিত হন। শিক্ষক শ্রেণী, গ্রাম্য ডাক্তারসহ, নানা পেশায় নিয়োজিত শিক্ষিত লোকজনই এই শ্রেণীতে পড়ে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটাভুটির ক্ষেত্রে এসকল লোকজন ভাল রকমের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এছাড়াও, তৃণমূলে রয়েছে দিন-মজুর, অল্প-শিক্ষিত এবং সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষজন। এই লোকগুলো জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। রাজনীতি নিয়ে তাদের এত মাথাব্যাথা থাকেনা। সারাদিন কাজ শেষে দোকানে গিয়ে একটু চা খায় শুধু, আবার কেউ কেউ মোড়েও যায় না দিনে একবার। সকাল হলেই জীবিকার তাগিদে তারা নিজের কিংবা অন্যের জমিতে কাজে নেমে পড়ে। রোদ-বৃষ্টি-খরা মাথায় নিয়ে কাজ করে সারাদিন। এই লোকগুলোই নির্বাচনের সময় নানাভাবে প্রভাবিত হোন আগের শ্রেণীর লোকজন দ্বারা।

একটু চা খাইয়ে ভালভাবে বোঝালে এরা কথা শোনে। গ্রাম এলাকার অনেক মানুষই অভাবী। হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করা হলে, অনেকেই বিশেষ প্রার্থীদেরকে ভোট দিতে রাজী হয়ে যান। অনেকে ভোটের দিন কিছু হাত-খরচ পেলেও খুশি। গরীব মানুষ। তাদের অত রাজনীতি বোঝার দরকার কী। সবার সাথে মিলেমিশে থেকে যতটুকু সুবিধা নেওয়া যায়, ততই তাদের জন্য মঙ্গল। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কী- এমনটিই চিন্তা করেন গ্রামের এই সাধাসিধে মানুষগুলো। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার সিংহভাগই বসবাস করে গ্রাম এবং মফস্বল এলাকায়।

তাই, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ভাল কিংবা খারাপ হওয়ার উপর নির্ভর করে একটি দেশের নানা আর্থ-সামাজিক বিষয় নির্দিষ্ট এলাকার জন-জীবনের উপর কিরূপ প্রভাব ফেলবে- ইতিবাচক না নেতিবাচক। তাই একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে যেরকম গুরুত্ব দেওয়া হয়, স্থানীয় নেতৃত্ব নির্বাচনেও ঠিক সেরকমই গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল কিংবা সরকারের নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তৃণমূলের নেতাগণই। বাস্তবায়ন যদি যথাযথভাবে না হয়, যত ভাল পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক না কেন- সেটি জনগণের কোন কাজে আসবে না।

সাধারণত, রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিংবা নির্দিষ্ট কোরাম ভিত্তিক। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই কেন্দ্রীয় কিংবা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ভিতরে দুই বা ততোধিক কোরাম থাকে। ফলে, যে সকল ব্যক্তি সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, তাঁরা তাঁদের কমিটিতে নিজস্ব কোরাম থেকেই বেশি সংখ্যক লোকদের পদ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে, একই রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া সত্বেও বিপক্ষ কোরামে থাকার কারণে অনেক সময় ভাল নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা রাজনৈতিক পদ থেকে বঞ্চিত হন। ফলে সাধারণ জনগণও পরোক্ষভাবে ভাল নেতৃত্বের উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হন। রাজনৈতিক দলগুলোর কেদ্রীয় কিংবা স্থানীয় ইউনিটের কমিটিতে যখন একই কোরামের লোকজন বেশি থাকে, তখন দল কিংবা সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা বন্টনের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। কেননা, এখানে দ্বিমত পোষণ করা কিংবা ভিন্ন ভাল কোন পরামর্শ দেওয়ার মত অন্য কোন নেতৃত্ব থাকে না। একই কোরামের সদস্য হওয়ায়, সম্পর্ক বিনিষ্ট হওয়ার ভয়ে কিংবা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় অনেকে নিশ্চুপ থাকেন। ফলে জনগণের জন্য সর্বোচ্চ সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

তাই তৃণমূল পর্যায়ে পদ-পদবী প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত কোরাম বিহীনভাবে কমিটি গঠন করে দেওয়া। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের হাতে পুরো কমিটি গঠনের ভার তুলে না দেওয়া। এক্ষত্রে অন্যান্য কোরামে ভাল নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তি থাকলে, তাদের দলীয় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ কম থাকবে। সবচেয়ে ভাল হবে, যদি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়। এর ফলে বর্তমান অবস্থা অপেক্ষা আরও বেশি জনবান্ধব এবং কল্যাণমুখী নেতৃত্ব নির্বাচন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলশ্রূতিতে সাধারণ জনতাও আরও বেশি উপকৃত হবে।

রায়হান কাওসার, আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও লেখক। ইমেইলঃ raihankawsardu@gmail.com

মতামতের জন্য লেখক দায়ী থাকিবেন।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj