সব
facebook apsnews24.com
জেন্ডার ইকুয়ালিটি - স্বরূপ ও অন্তরায় - APSNews24.Com

জেন্ডার ইকুয়ালিটি – স্বরূপ ও অন্তরায়

জেন্ডার ইকুয়ালিটি – স্বরূপ ও অন্তরায়

মতিউর রহমান

কোন পুরুষ নিজের গর্ভে সন্তান ধারণ করে এক্ষেত্রে একজন নারীর সমান হতে পারবে না। কোন পুরুষ বুকের দুধ খাইয়ে সন্তানের অকৃত্রিম খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। আবার, শক্তি-সামর্থের দিক থেকে একজন নারী একজন পুরুষের সমান হতে পারবে না। শারীরীক শক্তির উপর নির্ভরশীল কর্মে একজন নারী পুরুষের সমান দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে না। একজন নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অনেকদিন কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। আবার বাচ্চার খাবার যেহেতু নারীর শরীরে থাকে, সেহেতু বাচ্চা থাকাবস্থায় একজন পুরুষের মত একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কোন কাজে বাইরে থাকতে পারবেন না। বাস্তব কারণেই চাকরিতে নিযুক্ত একজন নারীর পুরুষের তুলনায় অধিক ছুটির দরকার হয়। এরকম হাজারো ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একে অপরের ইকুয়াল হতে পারবে না।

সুতরাং জেন্ডার ইকুয়ালিটি একটা ভিত্তিহীন অবান্তর ধারণা, তাইনা?-না, মোটেও অবান্তর ধারণা নয়।জেন্ডার ইকুয়ালিটির মূল বক্তব্য এমন না যে সব ক্ষেত্রেই ছেলে-মেয়ে ইকুয়াল হতে হবে। একটা ছেলে নিজেই তো অন্য সকল ছেলের সাথে সব দিক থেকে ইকুয়াল হতে পারবে না; যেমন- বুদ্ধিমত্তা, সাহস, শক্তি, উচ্চতা, ওজন, পৌরুষত্ব, পিতা হবার সক্ষমতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সকল পুরুষ অন্য পুরুষের মত সমান যোগ্য নয়। তাই বলে কি সকল পুরুষ আইনের চোখে সমান নয়?তেমনি, জেন্ডার ইকুয়ালিটি বলতে শুধুমাত্র আইনি প্রক্রিয়ার সামনে ইকুয়ালিটির কথা বলা হয়। যেমন- মত প্রকাশ, প্রফেশন, চলাফেরা, রাজনীতি, শিক্ষা, সম্পত্তি অর্জন প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলোতে জেন্ডার ইকুয়ালিটি থাকতে হবে এটাই জেন্ডার ইকুয়ালিটির মূল বক্তব্য।বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ এবং ২৯ হল এই দেশে জেন্ডার ইকুয়ালিটির মৌলিক ভিত্তি।তবে, সমান উত্তরাধিকার, রাজনীতি, চলাফেরা ইত্যাদি বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেক ধর্ম নারীকে পুরুষের মত সুযোগ প্রদান বা স্বাধীনতা সমর্থন করে না।

বস্তুত, জেন্ডার ইকুয়ালিটি অর্জনে ইকুইটির আশ্রয়ী হতে হবে। নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কিংবা প্রতি মাসে পিরিয়ডকালীন সময়ে এক্সট্রা যে কষ্ট করেন, এর জন্য তাদেরকে এক্সট্রা সুবিধা দিতে হবে; যেমন- ঐ সময়ে তাদের ছুটিসহ মজুরি দিতে হবে, তার সাথে আলাদা কেয়ারিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।এর সাথে আমি আরো কিছু প্রিভিলেজ যোগ করার দাবি করতে চাই। যেমনঃ- ১) প্রতি মাসে নারীদের পিরিয়ডকালীন সময়ে বেশি কষ্টকর ২/৩ দিন ঐচ্ছিক ছুটি দেয়া হোক।২) মাতৃত্বকালীন ছুটি তো সর্বজন গ্রহনযোগ্য হয়েছে অনেক আগেই, এর সাথে গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নেয়াসহ প্রপার কেয়ারিংয়ের জন্য কিছুদিন পিতৃত্বকালীন ছুটিও যুক্ত করা উচিৎ।৩) সিজারিয়ান অপারেশন বা সন্তান প্রসবকালীন চিকিৎসা সম্পূর্ণ ফ্রি প্রোভাইড করা সময়ের দাবী।৪) এর সাথে সাথে অস্বচ্ছল পরিবারের সকল মেয়েদের জন্য নিয়মিত ফ্রি স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রোভাইড করা উচিৎ। এই ব্যাপারগুলোর ট্যাবু দূর করে নারীদের কষ্টময় সময়গুলোকে সর্বোচ্চ পরিমাণে কামফোর্টেবল করতে হবে।৫) জেন্ডার ইকুয়ালিটির লক্ষ্য অর্জিত হবার পর দেনমোহর, ভরণপোষণের একক দায়-দায়িত্বের ভার পুরুষের উপর চাপিয়ে রাখা যাবে না।

নারী স্বাধীনতা, নারীর মর্যাদা, নারীর অধিকার, নারীর প্রতি ভালবাসা এইরকম বাণীগুলো মুখে মুখে কেবল মঞ্চ কাঁপানোর জন্য ব্যবহার না করে ব্যাবহারিক দিক থেকে তাদের জীবনকে সহজ করতে না পারলে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা প্রতিহত করা সম্ভব হবে না।দিনশেষে নারী আমাদের মা, নারী আমাদের বোন, নারী আমাদের স্ত্রী হিসেবে আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ করার আবশ্যিক সঙ্গী।তেমনি পুরুষ হল নারীর ভাই, পুরুষ তাদের পিতা, এই পুরুষই হল তাদের পরিপূরক।একইসাথে করুণ বাস্তবতা দেখা যায়, সমাজের পরতে পরতে পুরুষ হল নারীর ভোক্তা। এই ভোক্তা হবার মানসিকতা দূর না করলে সমাজে কখনোই শান্তি আসবে না।
এখন একটা বিচারের নজির উল্লেখ করি। সুবরুন্নেসা কেসে জাস্টিস মিত্র একটা পর্যবেক্ষণ দেন, মুসলিম বিবাহ হল পণ্য বিক্রয়ের চূক্তির মত।

এখানে নারী হল বিক্রিত পণ্যের মত, আর দেনমোহর হল এই বিক্রয় চূক্তির কনসিডারেশন (প্রাইস মানি)। যদিও ইসলামী শরীয়তে নিজের কন্যাকে বিক্রির ব্যাপার অনুমোদন করা হয় নি।তবে, বনু কোরায়জা গোত্রের নেতাদের অপরাধের জন্য তাদের সকল নারী ও শিশুকে মুসলিমরা সিরিয়ায় দাসী হিসেবে বিক্রি করেছিল। (সে গোত্রের সাবালক সকল পুরুষের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল)। অথচ এই নারীদের বা শিশুদের কোন দোষ ছিল না। নারীরা সে সমাজে ছিল অবলা। (সিরাত বা রাসূল (সাঃ) এর জীবনী গ্রন্থ)আবার ইসলামে সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের সাক্ষ্য = দুইজন নারীর সাক্ষ্য। এগুলো কোনভাবেই নারীর সমান মর্যাদা বলে গণ্য হতে পারে না। আবার দাসীর সাথে বা যুদ্ধবন্দিনী নারীর সাথে শারীরীক সম্পর্ক কোন কোন ধর্মে অনুমোদিত। এই শারীরীক সম্পর্ক জোরপূর্বক ছাড়া আর কিছুই নয়। বলাবাহুল্য কারোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরীক সম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বলে। সৃষ্টিকর্তার বিধান কীভাবে নারী ধর্ষণে উৎসাহিত করে আমার বোধগম্য নয়।

হিন্দু শাস্ত্রীয় আইনে দৈব, আসুরা, অর্শ্বা প্রভৃতি বিবাহে সরাসরি কন্যাকে বিক্রয় করা হয়, আর এই বিক্রয়ের মূল্য গ্রহণ করেন কন্যার পিতা।তাছাড়া, রাক্ষসা, পৈশাচা নামের বিবাহ প্রাচীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল। রাক্ষসা বিবাহের ক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় পুরুষ কোন নারীকে ধরে এনে জোর পূর্বক স্ত্রী বলে ঘোষণা করতে পারতেন।আবার পৈশাচা বিবাহের ক্ষেত্রে হিন্দু পুরুষ কোন নারীকে ধর্ষণের পর নিজের স্ত্রী বলে ঘোষণা করতে পারতেন। এতে তাদের কোন শাস্তি হত না, এবং সেই নারীরা তাদের স্ত্রী হিসবেই পরিচিত হতে বাধ্য থাকতেন।সেখান থেকে নারীর ফেরার কোন উপায় নেই। স্বামী চাইলেও হিন্দু নারীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে পারেন না। সনাতন ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের স্থান নেই।

সমান মর্যাদার প্রশ্নে অনেকে দাবি করেন নারীর পুরুষের সমান দূরদর্শিতা নেই, পুরুষের মত বুদ্ধি নেই। এ বিষয়টা বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। ধর্মসহ সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, সুযোগ-সুবিধা, পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গী, শিক্ষা সর্বোপরি মূল্যবোধ করুণ বৈষম্যমূলক হবার কারণের মূলত এই অবস্থা। যেসব নারী পুরুষের মত নিজেকে বিকাশের অনুকূল পরিবেশ পেয়েছেন, তারা ঠিকই মানসিকতায়, যোগ্যতায় পুরুষের মত অনেকদূর এগিয়েছেন।

নারী এবং পুরুষ একে অপরের প্রতিদন্দ্বী নন, বরং পরিপূরক। নারীকে মানুষ হিসেবে পুরুষের চেয়ে বেশি রেসপেক্ট করা উচিৎ। কেননা বায়োলজিক্যালি নারীর গর্ভেই পুরুষের সূচনা। সন্তান ধারণ, সন্তান প্রসবের কষ্ট ও মৃত্যু ঝুঁকি কেবলমাত্র নারীরাই নেন। আবার কষ্ট করে স্তন্যপান করিয়ে সকল মানব সন্তানের মুখে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে প্রথম খাবার তুলে দেবার একক ক্ষমতা কেবল নারীর। হাদিসেও বলা হয়েছে বাবার তুলনায় মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশি। এই মর্যাদার ক্ষেত্র কেবল পিতা-মাতার প্রতি সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজ জীবনের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়ুক। নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে না পারলে তাকে স্বাভাবিক মানুষ বলা দুষ্কর।
পরিশেষে বলব, নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে একে অপরের পরিপূরক হবার মানসিকতা লালন করতে হবে।

লেখক- মতিউর রহমান, ছাত্র, LL.B, 2015-16 Session,  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।01761426960e-mail-  motiurmdm@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj