সাধারণত কোন ক্রিমিনাল মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি তার উপর আনীত অভিযোগ আইন স্বীকৃত উপায়ে স্বীকার করে নেয়াকে স্বীকারোক্তি (confession) বলে। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ধারা ২৪-৩০ স্বীকারোক্তির (confessional statement) সাক্ষ্যগত মূল্য নিয়ে কথা বলে। সিআরপিসি ১৮৯৮ এর ধারা ১৬৪ ও ৩৬৪ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি গ্রহণ করলে সেটা সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী একটি সাক্ষ্য বলে বিবেচিত হবে।
সাক্ষ্য আইনের ধারা ২৫ থেকে ২৭ দেখলে প্রাথমিকভাবে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পুলিশের কাছে দেয়া কোন স্বীকারোক্তির (confession) সাক্ষ্যগত কোন মূল্য নেই। ধারা ২৫ ও ২৬ এ এরকম বিধান থাকলেও ধারা ২৭ একটু ব্যতিক্রম। এ ধারা অনুযায়ী পুলিশের কাছে দেয়া কোন স্বীকারোক্তি(নির্দিষ্ট অংশ) আদালতে নিয়ে আসা যেতে পারে এবং সাক্ষ্য বলে গণ্য হতে পারে। পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তির ঠিক কতটা সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে নিয়ে আসা যাবে সে বিষয়টিই আলোচনার বিষয়বস্তু।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ধারা ২৫ অনুযায়ী পুলিশ অফিসারের কাছে দেয়া কোন স্বীকারোক্তি (confessional statement) উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরূদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না বলে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। ধারা ২৬ অনুযায়ী পুলিশ অফিসারের হেফাজতে থেকে দিলেও সেটা তার বিরূদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না যদিনা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তার মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়।ধারা ২৫ এবং ২৬ এর একটি ব্যতিক্রম ধারা ২৭, “তবে, কোন বিষয় সম্পর্ক যদি এইরুপ সাক্ষ্য পাওয়া যায় যে, অপরাধে অভিযুক্ত ব্যাক্তি পুলিশ অফিসারের হেফাজতে ছিল এবং তাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত খবরের ফলে একটা বিষয় উদ্ ঘাটিত হইয়াছে, তাহা হইলে খবরের যে অংশ উদঘাটিত বিষয়ের সহিত স্পষ্টরুপে সংশ্লিষ্ট, তাহা স্বীকারোক্তী হউক বা না হউক, প্রমাণ করা যাইতে পারে।” অর্থাৎ এ ধারার অধীনে স্বীকারোক্তির একটা অংশ আদালতে নিয়ে আসা যাবে।
ধারা ২৭ থেকে কয়েকটি উপাদান পাওয়া যায়, (১) খবরটি/information স্বীকারোক্তি হতে পারে আবার নাও হতে পারে, (২) খবর/information দেয়া ব্যক্তিটি অবশ্যই কোন ক্রিমিনাল মামলায় অভিযুক্ত হতে হবে, (৩) ব্যক্তিটি পুলিশ হেফাজতে থাকতে হবে, (৪) ব্যক্তিটির নিকট থেকে প্রাপ্ত খবর থেকেই একটা বিষয় উদঘাটিত হয়েছে, (৪) তার দেয়া খবরটি/information উদঘাটিত বিষয়ের সাথে স্পষ্টরুপে জড়িত হতে হবে, (৫) তার দেয়া খবর/information এর শুধু ঐই অংশটুকুই আদালতে নিয়ে আসা যাবে যেটা থেকে মামলার সাথে জড়িত একটা বিষয় উদঘাটিত হয়েছে।উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পুলিশ অফিসারের কাছে কোন অভিযুক্তের দেয়া খবর/information, সেটা স্বীকারোক্তিও হতে পারে, চাইলে আদালতে নিয়ে আসা যাবে। এক্ষেত্রে ধারা ২৭ এর উপাদানগুলোকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। যেমন, কোন একজন ব্যক্তি হঠাৎ থানায় গিয়ে বললেন আমি আমার স্ত্রীকে খুন করে মৃতদেহটি বাসায় রেখে দিয়েছি এবং পুলিশ তৎক্ষনাৎ ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃতদেহ নিয়ে আসলো। এক্ষেত্রে ধারা ২৭ প্রয়োগ করা যাবে না কেননা এখানে কোন ক্রিমিনাল মামলা এখনো হয়নি। আবার ব্যক্তিটির দেয়া পুরো বক্তব্য আদালতে নিয়ে আসা যাবে না, শুধু ‘খুন হওয়া মৃতদেহটি আমার বাসায় রয়েছে’ অংশটুকু আদালতে নিয়ে আসা যাবে, কিন্তু ‘আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি’ এ অংশটুকু নিয়ে আসা যাবে না। আবার দেখা গেলো ব্যক্তিটি পুলিশ হেফাজতেও ছিলো না, একারণেও ধারা ২৭ এর প্রয়োগ হবে না। বাচ্চু বনাম রাষ্ট্র, ৩৫ ডিএলআর ১৭০, এ মামলায় একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশকে বলেছিলেন যে সে এবং আরও কয়েকজন মিলে একজনকে খুন করেছে এবং মৃতদেহটি যেখানে আছে সে জায়গা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে এবং তার দেয়া খবর/information অনুযায়ী মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয়েছিল। এ মামলায় আদালত বললেন অভিযুক্ত ব্যক্তির দেয়া ঐ অংশটুকু অর্থাৎ ‘মৃতদেহটি কোথায় আছে’ সেটুকুই আদালতে নিয়ে আসা যাবে আর বাকি অংশ ‘আমি এবং আরও কয়েকজন মিলে খুন করেছি’ এ অংশটুকু আদালতে নিয়ে আসা যাবে না।
ধারা ২৫ এ পুলিশের কাছে দেয়া কোন স্বীকারোক্তি তার বিরূদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না বলে যে বিধান আছে সেটা চাইলে উক্ত আসামী তার পক্ষে ব্যবহার করতে পারে, কারণ এ ধারায় এরকম স্বীকারোক্তি তার বিরূদ্ধে ব্যবহার না করার কথা বলা আছে কিন্তু তার পক্ষে ব্যবহার করার জন্য কোন বাঁধা নেই। যেমন হতে পারে একজন ব্যক্তি হঠাৎ রাগের মাথায় স্ত্রীকে হত্যা করে থানায় গিয়ে ঘটনাটি বললেন। এক্ষেত্রে পুলিশের কাছে দেয়া এ স্বীকারোক্তি আদালতে তার বিরূদ্ধে নিয়ে আসা যাবে না কিন্তু উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি এরকম ঘটনা ঘটানোর যে আকস্মিক ঝগড়ার কারণে হয়েছে এবং তার ইন্টেনশন আর মোটিভ প্রমাণ করার জন্য ধারা ৮ এর অধীনে চাইলে তার পক্ষে ব্যবহার করার জন্য আদালতে নিয়ে আসতে পারেন। এমনকি অন্য একজন সহ-অভিযুক্তের পক্ষেও ব্যবহার করা যেতে পারে (গুলাব বনাম ই. ২৬ সিআর এলজে ৫)। সর্বোপরি একজন পুলিশ অফিসারের কাছে দেয়া কোন অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি পুরোপুরি সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে নিয়ে আসা না গেলেও উক্ত খবর/information এর ভিত্তিতে উদঘাটিত বিষয়ের সাথে স্বীকারোক্তির সাথে জড়িত অংশকে সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে নিয়ে আসা যাবে তবে এক্ষেত্রে ধারা ২৭ এর উপাদানগুলো অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। ধারা ২৫ এবং ২৬ এর একটি ব্যতিক্রম হলো ধারা ২৭। এ ধারা অনুযায়ী কোন অভিযুক্তের দেয়া খবর/information অনুযায়ী উদঘাটিত কোন বিষয়কে উক্ত স্বীকারোক্তির অংশটুকুসহ আদালতে নিয়ে আসতে চাইলে পুলিশ অফিসারকে সতর্কতার সাথে অবশ্যই দেখতে হবে ধারা ২৭ এর উপাদানগুলো ঠিকভাবে পূরণ করেছে কিনা নয়তো উক্ত বিষয়টি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত না হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
লেখকঃ সোয়েব আক্তার, শিক্ষার্থী, ৩য় বর্ষ এলএলবি সম্মান, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইলঃ sasehab833488@gmail.com