মো. আনোয়ারুল হাকিম আরাফাত
বিবাহ প্রত্যেক ধর্মে স্বীকৃত একটি পবিত্র বন্ধন। যার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীতে বংশ রক্ষায় সন্তান জন্মদান। এই বিবাহটি স্থায়ী রুপ দেয়ার পূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক চলমান অবস্থায় আমাদের দেশে কিছু মানুষরুপী তথাকথিত ব্যক্তি বিবাহ স্থির রাখার জন্যে দাবি করে থাকে যৌতুক নামে আর্থিক প্রণোদনা যা প্রদান করতে গিয়ে অনেক হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত পরিবারকে গ্রামের মহাজন বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন বা টাকা ধার নিয়ে মোটা সুদে উক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এভাবে আর্থিকভাবে ভেঙে পড়ে হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার। ফলে বিনষ্ট হয় শত বছরের ঐতিহ্যের বন্ধন।
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, অভিশাপ বললেও হয়তো ভুল হবেনা। যা স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশে চলমান বলতে গেলে কিছু এলাকায় দীর্ঘ স্থায়ী প্রথা হয়ে দাড়িয়েছে। আর এতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে স্থানীয় কিছু লোক যা মোটেও কাম্য নয়। হিন্দু আইনে যৌতুক স্বীকৃত হলেও মুসলিম আইনে যৌতুক স্বীকৃত নয়, তবে মুসলিম আইনে স্বামী কর্তৃক ভালোবাসার প্রতিদান স্বরূপ স্ত্রীকে প্রদত্ত দেনমোহর কোনভাবেই যৌতুক নয়। আসুন এই ঘুনেধরা সমাজে বিদ্যমান যৌতুকের বিরুদ্ধে দেখে নিই আইন কি বলে…
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ মতে যৌতুক বলতে বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্ব শর্ত হিসেবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বিবাহ অব্যাহত রাখার শর্তে বিবাহের কোন পক্ষ বাবদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দাবিকৃত কোন অর্থ সামগ্রী বা অন্য কোন সম্পদকে বুঝায়। এই আইন অনুযায়ী বিবাহ স্থির রাখার শর্তে যৌতুক দাবি করা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। আদালতে প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ ও অন্যূন ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন [ধারা ৩]। যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া একই অপরাধ বলে গণ্য হবে, প্রমাণিত হলে ৩ ধারায় উল্লেখিত শাস্তি ভোগ করতে হবে [ধারা ৪]। এই আইন অনুযায়ী, যদি বিবাহের পক্ষদ্বয়ের মধ্যে যৌতুক সংক্রান্ত কোন চুক্তি হয় তা বাতিল বলে গণ্য হবে [ধারা ৫]। এই আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনঅযোগ্য ও আপোষযোগ্য [ধারা ৬]। এই আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধের মামলা হবে স্থানীয় থানায় বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং মামলা দায়েরের কোন তামাদি নেই। তবে মিথ্যা মামলা দায়ের বা অভিযোগ করলে উক্ত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই আইনে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে (sue moto) মিথ্যা মামলা দায়ের কারীর বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ আমলে নিতে পারেনা। তবে উভয় পক্ষ মামলা দায়ের করতে পারে।
এতক্ষণ আমরা জানলাম বিবাহ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে যৌতুক সংক্রান্ত অপরাধ হলে আইনি প্রতিকার। এবার জানব বিবাহ স্থির থাকা অবস্থায় বরপক্ষ কর্তৃক যৌতুক দাবি করতে গিয়ে স্ত্রীর মৃত্যু ঘটানো বা গুরুতর জখম বা সাধারণ জখম হলে কনেপক্ষ কর্তৃক কি কি প্রতিকার চাওয়ার আছে- এসব অপরাধের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ প্রযোজ্য হবে। বিবাহ স্থির থাকা অবস্থায় কোন নারীর স্বামী বা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি যৌতুকের দাবিতে মৃত্যু ঘটালে একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ড। আর মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আরা মারাত্মক জখম (grievous hurt) করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক ১২ বছর, তবে অন্যূন ৫ বছর কারাদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। সাধারণ জখম (simple hurt) করলে অনধিক ৩ বছর, তবে অন্যূন ১ বছর কারাদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে [ধারা ১১]।
এই আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধের বিচার করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল, যার বিচারক হলেন জেলা ও দায়রা জজ বা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ [ধারা ২৬] । এই আইনে কেবল সাধারণ জখমের অপরাধ আপোষযোগ্য যা আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। তা সংবিধানের ১১১ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের সকল আদালত ও কর্তৃপক্ষ মানতে বাধ্য। এই আইনের সাজার বিরুদ্ধে ৬০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করা যাবে। এই আইনে মামলা থানায় ও ট্রাইবুনালে দায়ের করা যায়৷ কেউ মিথ্যা মামলা দায়ের করলে যে কোন ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইবুনাল সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অনধিক ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ারও বিধান আছে [ধারা ১৭]।
মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ একটি পবিত্র ইবাদত এবং দেওয়ানী আইন অনুযায়ী চুক্তি। এই পবিত্র বন্ধন স্থির রাখার শর্তে যৌতুক দাবি কখনো সভ্য সমাজের মাপকাঠি হতে পারেনা। তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন। যৌতুক মুক্ত সমাজ ও জাতি হউক আগামী প্রজন্মের অহংকার।
লেখক:মো. আনোয়ারুল হাকিম আরাফাত আইন কর্মকর্তা,অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডএবংঅ্যাডভোকেট,জজ কোর্ট, ঢাকাইমেইল: adv.anwardu@gmail.com